যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫% শ্রমিক-কর্মচারীদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়!

নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: শুক্রবার ৫ই জুলাই ২০১৯ ১১:২৩ অপরাহ্ন
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫% শ্রমিক-কর্মচারীদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়!

কর্মসংস্থান, চিকিৎসা পরিষেবা, প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধির বিচারে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র মান্ধাতার আমলের লঙ্কাপুরী ও ভূস্বর্গ। তাই আমেরিকার মায়ামরীচিকার হাতছানিতে প্রলুব্ধ হয়ে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার অনুপ্রবেশকারী অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য যমদূত আজরাইলের সাথে লড়তেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তাই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫% শ্রমিক-কর্মচারীদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা বললে আমেরিকার আজন্মের শত্রু রাষ্ট্রের অধিবাসীরাও তা মানতে রাজি হবেন না।

বিশ্ববাসীর নিকট অবিশ্বাস্য মনে হলেও বস্তুত বহু সংখ্যক আমেরিকান এবং শ্রমিক-কর্মচারীদের ৪৫% পে-চেক টু পে-চেক নির্ভর (দিনে আনে, দিনে খায় বা নুন আনতে পান্তা ফুরার মতো নিয়তি) জীবন নির্বাহ করছেন। আর এই দৈন্যক্লিষ্ট ও নিয়তি লাঞ্ছিত জীবনের অভিশাপ আংশিকভাবে মোচনের জন্য স্বল্প আয়ের অদক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীরা নিয়মিত কাজের বাইরেও সপ্তাহে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা বাড়তি কাজ করে বাড়তি অর্থোপার্জনে বাধ্য হন। ১ জুলাই প্রকাশিত বানক্রেটের সর্বশেষ সাইড হাসেলের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা এবং চাকরির তেজি বাজার সত্ত্বেও আমেরিকান শ্রমিক-কর্মচারীদের ৩০% চাকরির সীমিত অর্থে পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে চোখে সরষে ফুল দেখেন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর জন্য মূল কাজের পাশাপাশি খ-কালীন কাজও করেন।

১ হাজার ৫৫০ জন প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকানের ওপর জুনের শেষ সপ্তাহে জরিপকাজ পরিচালনা করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীগণ বলেন, প্রারম্ভিক মজুরি নিতান্ত কম না হলেও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সাথে মজুরি বৃদ্ধির সামঞ্জস্য না থাকায় অভাব-অনটন তাদের জীবনে স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসেছে। ডবস ফেরি মার্সি কলেজের সহকারী অধ্যাপক আলেকজান্দ্রিয়া রেভেনেলে বলেন, বেশ কিছুকাল পর্যন্ত আমাদের মজুরিতে বন্ধ্যাদশা বিরাজ করছে। রেভেনেলে আরও বলেন, আয় আর্থিক মহামন্দার আগের অবস্থায় ফিরে এলেও অনেকে আয় দিয়ে ব্যয় নির্বাহ করতে পারছেন না। মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

সামগ্রিকভাবে ৪৫% শ্রমজীবী আমেরিকান জানান যে কায়ক্লেশে প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে তাদের প্রাইমারি (মূল) চাকরির বাইরে কাজ করে অর্থোপার্জন করতে হচ্ছে। ৪৩% সার্বক্ষণিক কর্মচারীর বেলায় বক্তব্যটি সত্য বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়ের সাহায্যে ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে অনেক ছাপোষা কর্মজীবী দায়ে ঠেকে মূল চাকরির পাশাপাশি প্রায়ই খ-কালীন চাকরিও করে থাকেন। আবার মূল চাকরির বেতন দিয়ে কায়ক্লেশে সংসার চালানো গেলেও সঞ্চয় বলতে কিছু না থাকায় কেউ কেউ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে মূল চাকরির পাশাপাশি খ-কালীন চাকরিও করে থাকেন।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে চলতি গ্রীষ্মে অনেকের অবকাশযাপনের সাধ থাকলেও সাধ্যের অভাবে তা বাস্তবায়িত হবে না। বর্ষীয়ান আমেরিকানদের তুলনায় ভবিষ্যৎ স্বপ্নপ্রত্যাশী আমেরিকানদের বেশির ভাগ বলেছেন যে অধিক পরিমাণ অর্থ সঞ্চয়ের লক্ষ্যে তারা মূল চাকরির পাশাপাশি টুকটাক অন্যান্য কাজের মাধ্যমে বাড়তি আয় করে থাকেন। সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য বাড়তি ঘণ্টা কাজ করে ২৩ থেকে ৩৮ বছর বয়সী আমেরিকানদের ৩১%; আর অশীতিপর বৃদ্ধদের ১৬% এবং ৭০ বছর তদূর্ধ্ব বয়সীদের ১৮%। সহকারী অধ্যাপক রেভেনেলে বলেন, ভবিষ্যৎ সুখ-স্বপ্ন প্রত্যাশীদের গ্রেট রিসেসন বা আর্থিক মহামন্দার ধকল সইতে হয়েছে। সম্ভবত অন্যান্য জেনারেশনের লোকজনের তুলনায় সুখ-স্বপ্ন প্রত্যাশীরা আর্থিক নিরাপত্তা নেটের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি উপলব্ধি করেন। সুস্থ-সবল-কর্মক্ষম ভবিষ্যৎ সুখ-স্বপ্ন প্রত্যাশীদের ৪০% জানান যে তারা নিজেদের আয়ের পরিমাণ বাড়ানোর জন্যই মূলত নির্দিষ্ট চাকরির বাইরে খ-কালীন কাজ করেন। তারা আরও জানান যে নিজেদের মাসিক আয়ের কমপক্ষে অর্ধেক অংশ তারা বাড়তি কাজের মজুরি থেকে উপার্জন করে থাকেন।

বানক্রেটের চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট গ্রেগ ম্যাকব্রাইড বলেন, গত দশকে কাজের প্রকৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত না হওয়ায় এবং মজুরিতে স্থিতাবস্থা বজায় থাকায় কম বয়সী আমেরিকান কর্মজীবীরা বাড়তি আয়ের মাধ্যমে সঞ্চয় বাড়ানো এবং দক্ষতা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর নিমিত্তে মূল কাজের পাশাপাশি নতুন কর্মকা-েও জড়িয়ে পড়েছে। বানক্রেটের পরিচালিত জরিপে আরও দেখা গেছে যে সর্বাপেক্ষা গরিব উত্তরদাতাদের তুলনায় বিত্তশালী এবং শিক্ষিত কর্মজীবী আমেরিকানরাই অধিক হারে মূল চাকরি ছাড়াও খ-কালীন কাজ করে থাকেন। জরিপে আরও দেখা গেছে যে বার্ষিক ৩০ হাজার ডলারের কর্ম উপার্জনকারীদের ৩৭% আর বার্ষিক ৮০ হাজার ডলার বা তার চেয়ে বেশি উপার্জনকারী আমেরিকানদের ৪৩% মূল কাজ ছাড়াও বাড়তি কাজে জড়িত থাকেন।
ম্যাকব্রাইড বলেন, সম্পদের পরিমাণ বাড়ানোর নীতিমালা হচ্ছে জলে বহুসংখ্যক লাইন থাকা অর্থাৎ আয়ের নানাবিধ উৎস আবিষ্কার করা। ম্যাকব্রাইড আরও বলেন, উচ্চশিক্ষিত, অনন্যসাধারণ দক্ষ এবং প্রতিভাসম্পন্নরা অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় সর্বোত্তম স্থানে অবস্থান করছেন।

প্রতিবেদন অনুসারে, কর্মজীবীরা আমেরিকানরা নিজেদের পূর্ণকালীন কর্মঘণ্টার বাইরেও সপ্তাহে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা বাড়তি কাজ করেন এবং গড়ে মাসে ১ হাজার ১১২ ডলার হিসেবে বছরে ১৩ হাজার ডলার বাড়তি আয় করেন। আর নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসারের প্রাত্যহিক জীবনের নৈমিত্তিক ব্যয় নির্বাহে উক্ত অর্থ তাৎপর্যম-িত অবদান রাখে। ম্যাকব্রাইড বলেন, সকল আমেরিকান শ্রমজীবী যে সপ্তাহে ১২ ঘণ্টা খ-কালীন কাজের মাধ্যমে বছরে ১৩ হাজার ডলার আয় করতে পারেন, বাস্তবে তা নয়। কারণ খ-কালীন কাজ নির্ভর করে চাহিদা এবং কর্মদক্ষতার ওপর। তিনি আরও বলেন, সামগ্রিকভাবে সকল আমেরিকান কর্মজীবী যে নিয়মিত কাজের বাইরে খ-কালীন কাজের মাধ্যমে নিজেদের সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়াতে পারেন, তাও নয়। অদক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীরা বাড়তি আয়ের সাহায্যে কায়ক্লেশে পরিবারের সদস্যদের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। আর উবার এবং লিফট চালকদের মতো শ্রমজীবীরা কারের রক্ষণাবেক্ষণ খরচাদি নির্বাহ করে থাকেন। মোদ্দা কথা, অদক্ষ শ্রমিকরা নিয়তি লাঞ্ছিত জীবনের দায় মেটাতে গিয়েই নিয়মিত চাকরির বাইরে খ-কালীন চাকরি করতে বাধ্য হন।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব