আপনি কি ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুক চেক করেন? রাতে ঘুমানোর আগে বেশ কিছুক্ষণ ফেসবুক ব্যবহার করেন? ফেসবুক কি আপনার অবসরের একমাত্র চয়েস? হাতে একটু সময় পেলেই আপনি কি ফেসবুকে ঢুকে পড়েন? ফেসবুক ছাড়া একটি দিন আপনি কি কল্পনাও করতে পারেন না? যদি সবকটি প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় আপনি একজন ফেসবুক আসক্ত।
আমরা কোন একটি কাজ যদি কিছুদিন নিয়মিত করি তাহলে সেটি আমাদের অভ্যাস হয়ে উঠে। ঠিক তেমনিভাবে ফেসবুক ব্যবহারও আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পেশাগত প্রয়োজন ছাড়া ফেসবুক বা স্যোশাল মিডিয়ায় আমরা দিনের একটা বড় সময় অযথা নষ্ট করি। ফলে পড়াশুনা ও কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টির পাশাপাশি মন ও মস্তিস্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
একাকীত্ব বাড়ায়
ফেসবুক আমাদের একাকীত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বর্তমান ডিজিটাল অনলাইন যুগে স্যোশাল মিডিয়ার বিস্তৃতি যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে আমাদের ভার্চুয়াল (বায়বীয়) বন্ধুত্ব। বিপরীতে কমছে আমাদের বাস্তব বন্ধুর সংখ্যা। ফেসবুক হচ্ছে স্যোশাল মিডিয়ার সবচেয়ে বড় ফ্ল্যাটফর্ম। কিন্তু ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে যেটা সবচেয়ে কম দেখা যায় তা হল স্যোশাল স্কীল। যার ফলে তারা বাহিরের জগতের মানুষের সাথে সঠিকভাবে যোগাযোগ করতে পারে না এবং একাকীত্ব ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। তাছাড়া যাদের স্যোশাল সাপোর্ট কম থাকে বা যারা একটু অর্ন্তমুখী হয় তাদের কাছে ফেসবুক-ই একমাত্র অবলম্বন। যা তাদের একাকীত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
মনোযোগ নষ্ট করে
ফেসবুক আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে দেয়। মদ্যপান করে ড্রাইভিং এবং পড়তে বসে ফেসবুক চ্যাটিং দু’টোই সমান ক্ষতিকর। মনোযোগ সহকারে কোন কাজ করার সময় বা গণিতের জটিল কোন সমীকরণ সমাধানের সময় মেসেঞ্জারের একটা টুং শব্দও আমাদের মনোযোগ নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। তারপর যদি হাতটা স্ক্রীনে চলে যায় তাহলেই কাজের বারোটা বেজে যায়। সময় অপচয়ের সাথে নষ্ট হয় মনোসংযোগ। আর ফোন রেখে মনোযোগ আবার সেই আগের জায়গায় ফিরে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। এরকম যদি বারবার ঘটতে থাকে তাহলে সেটি আমাদের মনোযোগ শক্তিকে পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। যা আমাদের কাজের প্রোডাক্টিভিটি কমিয়ে দেয়।
হিংসাত্মক মনোভাবাপন্ন
মাত্রাতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার আপনার মনোভাবকে করে তুলে জেলাসি বা হিংসাত্মক। এই জেলাসিভাবটি কীভাবে কাজ করে? ধরুণ, আপনি ফেসবুক নিউজফিডে দেখলেন আপনার বন্ধুরা আইফোন হাতে ছবি পোস্ট করেছে বা কেউ আপনার পছন্দের বাইকের সাথে ছবি তুলে পোস্ট করেছে অথবা কোথাও ভ্রমনের ছবি পোস্ট করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এ দেখে আপনি ঈর্ষান্বীত হয়ে উঠবেন। কারণ আপনার তখন মনে হবে বন্ধুরা আপনার চেয়ে সামাজিক স্ট্যাটাসে ভালো অবস্থায় পৌঁছে গেছে। মনে হবে আপনি তাদের থেকে পিছিয়ে আছেন। এ তাড়না আপনাকে যে কোন উপায়ে উক্ত জিনিস পেতে অস্থির করে তুলবে। আর এ চিন্তাভাবনা আপনার স্বাভাবিক মানুষিক বিকাশকে নষ্ট করে দেয় এবং ধীরে ধীরে আপনি অসহিষ্ণু ও পরশ্রীকাতর হয়ে উঠেন।
নিরাপত্তাহীনতা
ফেসবুকে আপনি নিরাপদ নন। আপনি যদি স্মার্টফোন ব্যবহারকারী হন এবং আপনার ফোনে যদি ফেসবুক অ্যাপসটি থেকে থাকে তাহলে আপনি বা আপনার ডাটা সুরক্ষিত নয়। একটা সময় ছিলো যখন যার যত সম্পদ ছিল সে তত ধনী কিন্তু বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যার কাছে যত ডাটা বা তথ্য আছে সে তত ধনী। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তার ইউজারকারীদের ডাটা চুরির দিক থেকে প্রথম। এর প্রথম ও প্রধান কারণ হলো এ সামাজিক মাধ্যমটি সবার জন্য উন্মুক্ত। আর যেখানে আপনি ফ্রী’তে এত পরিসেবা পাচ্ছেন সেখানে আপনার তথ্যই হলো তাদের কাছে পণ্য। আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন যে, আপনি কোন শপিংমলে কেনাকাটা করতে গেলেন তারপর থেকে দেখবেন আপনার ফেসবুকে সেই শপিংমলের অ্যাড চলে আসে। তার মানে আপনি কোথায় যাচ্ছেন ঘুরছেন সবকিছুই ফেসবুক রেকর্ডে থাকছে।
তারপর ধরুন আপনি অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ড বা গুগলে কোন একটি বিশেষ জিনিস যেমন ধরুণ কোন স্মার্ট ফোনের ব্যাপারে সার্চ করলেন। অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করবেন তারপর থেকে সেই ফোনটির অ্যাডস্ বারবার আপনার ফেসবুকের নিউজফিডে পাচ্ছেন। এর কারণ হলো ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আপনার সার্চিং হিষ্টিও স্টোর করে রাখে। এজন্য আপনি যা-ই সার্চ করেন তার জন্য আপনার ফেসবুক নিউজফিডে সে সম্পর্কিত পণ্যের অ্যাডস্ চলে আসে।
ফেসবুক তার ব্যবহারকারীদের আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু হাতিয়ে নেয়। সেটা দেখার জন্য আপনাকে ডেক্সটপে যেতে হবে। প্রথমে আপনি আপনার আইডি দিয়ে ফেসবুকে লগইন করে সেটিংসে ঢুকবেন, তারপর ডাউনলোডে কপি অব ইউর ফেসবুক ডাটাতে ক্লিক করবেন। তারপরে আপনি দেখতে পাবেন ফেসবুকের কাছে আপনার কী কী ইনফরমেশন আছে। আপনার ফেসবুক পোস্টস, লাইকস্, কমেন্টস, ফটোস্, ভিডিওস্, মেসেজেস সবই আছে। এর বাইরেও এমন কিছু আছে যা দেখলে আপনি অবাক হবেন। আপনার সার্চি হিস্ট্রি, লোকেশন হিস্টি, আপনি কোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন এমনকি আপনার কন্টাক্টসে কে কে আছে। আপনি কাকে কখন কল করেছেন সেই কল লগস্। কাকে কখন মেসেজ করেছেন সেই মেসেজ হিস্টিও আছে ফেসবুকের কাছে।
মস্তিস্কের কর্মকাঠামো পরিবর্তন
দিনের বেশীরভাগ সময় যারা স্যোশাল মিডিয়া বা ফেসবুক ব্যবহারের আকর্ষণ অনুভব করেন এমন মানুষদের মস্তিস্কের প্যাটার্নের সাথে মাদকদ্রব্য ও জুয়ায় আসক্ত মানুষের মস্তিস্কের প্যাটার্নের মিল খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। ছবি, ভিডিও বা লেখায় লাইক পাওয়ার আগ্রহ মস্তিস্কে নিঃসরণ করে ডোপামিন নামক হরমোন। ড্রাগ গ্রহণের সময় বা জুয়ায় জিতলে মস্তিস্কে এই হরমোন নিঃসরণ হয়ে থাকে। (দ্যা সান, ৬ জুলাই ২০১৬ প্রকাশিত)। গবেষকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ আসক্তিকে ‘ডিজিটাল কোকেন’ হিসেবেও অবিহিত করেছেন।
অনলাইন জগৎ, এখানে আপনিই প্রোডাক্ট। আপনি ভাবছেন আপনার ব্যাক্তিগত তথ্য নিয়ে ফেসবুক কী করবে। কিন্তু আপনার এ তথ্য পণ্য বিক্রেতাদের কাছে মহামূল্যবান। তাছাড়া একবার ভেবে দেখুন আপনার অজান্তেই আপনার সমস্ত ডাটা চলে যাচ্ছে ফেসবুকের ডাটাবেজে। এরপর যদি আপনার ফেসবুক কখনও হ্যাক হয়ে যায় তাহলে শুধু আপনার ফেসবুক আইডিই চুরি হলো না, চুরি হয়ে গেল আপনার সমস্ত গোপনীয়তা। সুতরাং পেশাগত ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফেসবুক ব্যবহারে সচেতন হোন।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।