দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে গত কয়েক দিন ধরে বেড়েই চলছে শীতের প্রকোপ। উত্তর দিক থেকে আসা হিমালয়ের হিম বাতাস আর ঘন কুয়াশার কারণে জেলার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শীতের প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত নানা রোগ।
জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া এবং শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ভর্তি হচ্ছে রোগীরা। তবে সবেচেয়ে বেশি রোগী পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, গত কয়েক দিনের রোগীর চাপে হাসপাতালে তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই। হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালে শয্যা না পাওয়ায় বারান্দা এবং মেঝেতেই চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন অনেকেই। শিশুদের সঙ্গে বৃদ্ধরাও আক্রান্ত হচ্ছেন ঠান্ডাজনিত রোগে।
শিশুদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসা মায়েদের টিকিট বিভাগে দেখা গেছে লম্বা লাইন। অনেকেই বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরছেন। তবে বেশির ভাগ শিশুকেই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হচ্ছে। ১০০ শয্যার পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে শিশু শয্যা রয়েছে মাত্র ১৬টি৷ কিন্তু ১৬ জনের বিপরীতে প্রতিদিন ৫০-৬০ জন শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। এছাড়াও প্রতিদিন বহির্বিভাগে থেকে আড়াই শতাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। হাসপাতালের মাত্র একজন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসাসেবা। এতে রোগী ও রোগীর স্বজনদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, সময় মতো কিংবা প্রয়োজনে নার্সদের ডাকলে পাওয়া যায় না। এছাড়াও পর্যাপ্ত খাবার ও ওষুধ সরবরাহ দেওয়া হয় না। অনেকে এখানে কাঙিক্ষত চিকিৎসা না পেয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, ১০০ শয্যা বিশিষ্ট পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে শিশু শয্যা মাত্র ১৬টি। তবে তা বাড়িয়ে ২৩টির মতো করা হয়েছে। প্রতিদিন কমপক্ষে অর্ধশতাধিক শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। চিকিৎসক সংকট থাকলেও হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ মজুদ রয়েছে। জেলা শহরের এই হাসপাতালে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে সেবা দেওয়া খুব কঠিন। বর্তমানে আবাসিক মেডিকেল অফিসাররা সবাই মিলে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন।
অন্যদিকে ১০০ শয্যা হাসপাতালে প্রতিদিন ১০০ জনের জন্য খাবার সরবারহ করা হয়। কিন্তু রোগী রয়েছে ৪/৫শ। তাই সবাইকে খাবার দেওয়া সম্ভব নয়। হাসপাতালের পক্ষ থেকে ভাগ ভাগ করে একেক দিন একেক রোগীকে খাবার দেওয়া হয়।
ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সোলেমান আলী বলেন, হঠাৎ করে আমার ছেলে অসুস্থ। রাত আড়াইটার দিকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। বেড না পাওয়ায় মেঝেতে থাকতে হয়েছে। এখন কিছুটা ভালো আছে। সুস্থ হলে বাড়িতে নিয়ে যাব।
এ বিষয়ে কথা হয় বোদা উপজেলা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সবুজ আলী নামে এক রোগীর স্বজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি ছেলেকে নিয়ে কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছি। রোগী আগের চেয়ে কিছুটা ভালো আছে। কিন্তু হাসপাতালে তেমন চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। বেশিরভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসতে হচ্ছে।
একই কথা বলেন সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের মডেল পখুরীডাঙ্গা থেকে নাতিকে চিকিৎসা করাতে আসা জাহানারা বেগম। তিনি বলেন, কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে আছি, কিন্তু চিকিৎসা তেমন পাচ্ছি না। তিন দিন পর আজকে ভাত পেয়েছি। কিন্তু দেখলাম মাছের তরকারি, পেলাম আলু। অনেকে তরকারি পেয়েছে কিন্তু মাছের শুধু মাথা। ভাতের পরিমাণও কম। প্রয়োজনে নার্সদের ডাকলে রোগীদের কাছে আসেন না। হাসপাতালে নোংরা পরিবেশ, ওষুধ ও চিকিৎসক সংকট। এসব সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও কোনো সমাধান হচ্ছে না।
পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের কনসালটেন্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পঞ্চগড় শীতপ্রবণ জেলা হওয়ায় প্রতি বছর শীত মৌসুমে হাসপাতালে শীতজনিত রোগীর চাপ বাড়ে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর শিশু রোগী বেশি। বেশির ভাগ শিশু রোগী প্রচন্ড জ্বর, সর্দি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। সহজেই শিশুদের শরীর থেকে জ্বর নামছে না। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ হাসপাতালে মজুদ রয়েছে। এজন্য শিশু রোগীদের সাপোর্ট দেওয়া যাচ্ছে।
পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. সিরাজউদ্দৌলা পলিন বলেন, শীতজনিত রোগের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। শিশুরা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্ট ভুগছে। এছাড়াও বয়স্করা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন । বর্তমানে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছেভ তবে চিকিৎসাসেবা চলমান রয়েছে। আমরা রোগীদের যথাযথ চিকিৎসাসেবা প্রদান দিয়ে যাচ্ছি।
পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন ডা. ফজলুর রহমান বলেন, আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রোগীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা কম, কিন্তু রোগীর সংখ্যা বেশি। শীতজনিত রোগীর চাপ বেড়ে গেলেও আমরা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে, নার্স রয়েছে। আমরা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের চেষ্টা করছি।
এদিকে শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৯ সেলসিয়াস। যা আজ সারা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।