রাজবাড়ীতে উচ্চপদস্থ নারী কর্মকর্তাদের সফলতার গল্প

নিজস্ব প্রতিবেদক
মইনুল হক মৃধা-রাজবাড়ী জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: শনিবার ৮ই মার্চ ২০২৫ ০৭:৪৯ অপরাহ্ন
রাজবাড়ীতে উচ্চপদস্থ নারী কর্মকর্তাদের সফলতার গল্প

নারী, মা-বোন ঘরের চার দেয়ালে মাঝে সাজিয়ে রাখা বস্তুু নয়। শত বাঁধা ও বৈষম্য অতিক্রম করে শহর থেকে গ্রামের নারী এখন এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ব দরবারের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরা নেতৃত্বে স্থানে এগিয়ে যাচ্ছেন।


সেই ধারাবাহিকতায় পদ্মা কন্যা রাজবাড়ী জেলায় নারী নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল উদারহণ হয়ে উঠেছে। ডিসি, এসপি, ইউএনও, বিচারক, ডাক্তার সহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। 


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মা কন্যা খ্যাত রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক মিজ সুলতানা আক্তার, রাজবাড়ী পুলিশ সুপার মোছা. শামীমা পারভীন, সিনিয়র জেলা ও দাদরা জজ মোছা. জাকিয়া পারভীন, উপ-পরিচালক স্থানীয় সরকার মল্লিকা দে, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) নাদিয়া জুঁই, অতিরিক্ত জেলা ও দাদরা জজ জান্নাতুন লিলিফা আক্তার, রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মারিয়া হক, কালুখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহুয়া আফরোজ ও রাজবাড়ী মেডিকেল অফিসার (কো-অর্ডিনেটর) ডা. ইসরাত জাহান।  


মিজ সুলতানা আক্তার রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। নিঃস্বার্থ ভালবাসা অর্জন করেছেন জেলার সাধারণ মানুষের। ভালবাসা অর্জন করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থী ও রাজনীতিক নেতাকর্মীদের। অল্প কিছু দিনের মধ্যে তার নেতৃত্বে জেলা প্রশাসক ইতিমধ্যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করেছেন। জনগণের সমস্যা সমাধান এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডে তার অবদান ব্যাপক প্রশংসিত। অসহায় নারী ও শিশুদের উন্নয়নের জন্য এরই মধ্যে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছেন। উদ্যোগ নিয়েছেন মাদক ও ইভটিজিং বিরোধী সচেনতা মূলক নানা কর্মকান্ড।


নদী ভাঙন কবলিত এই রাজবাড়ী জেলা পদ্মা নদীর পারে অবস্থিত। জেলার ৫টি উপজেলার মধ্যে পাংশা, কালুখালী, গোয়ালন্দ ও সদর উপজেলা নদী ভাঙন এলাকা। প্রতিবছর নদী ভাঙনের কবলে পড়ে গৃহহীন হচ্ছে শত শত পরিবার। নদী গর্ভে যাচ্ছে শতশত একর আবাদি জমি। সেই সকল নদী ভাঙন কবলিতদের ভরসার স্থল হয়ে উঠেছেন বর্তমান জেলা প্রশাসক। দেশের বৃহত্তম যৌনপল্লী দৌলতদিয়া। এই যৌনপল্লীতে প্রায় ১৫'শত যৌনকর্মী এবং যৌনকর্মীদের জম্মের প্রায় ৭শতাধিক শিশুদের নিরাপদ ও আশ্রয়ের ভরসা। এই সকল কোমলমতী শিশুদের নিরাপদে লালন-পালন ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা করছেন। যৌনকর্মী ও তাদের শিশুদের নিয়ে কাজ করা সামাজিক সংগঠন কেকেএস, গণস্বাস্থ্য ও পায়াক্ট বাংলাদেশ এর সাথে আলোচনা করছেন কিভাবে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বিপথগামী ৭'শতাধিক শিশুর উন্নয়ন করা যায়। কিভাবে এই শিশুদের মাদকমুক্ত রাখা যায়। কিভাবে মেয়ে শিশুদের মায়ের পেশা থেকে বিরত রাখা যায়।


রাজবাড়ী জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোছা. শামীমা পারভীন। জেলার আইন-শৃঙ্খলার মত গুরুদায়িত্ব পালন করছেন দক্ষতা ও সততার সাথে। সমাজে নারী নির্যাতন, মাদক নিয়ন্ত্রন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মোবাইল-মোটরসাইকেল চুরি ও অন্যান্য অপরাধ দমনে তার অবদান অপরিসীম। নারীদের একটি নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলতে কাজ করছেন চৌকস এই অফিসার। দিনে দিনে অপরাধীদের আতংক ও সাধারণ মানুষের ভরসার স্থল হয়ে উঠেছেন এসপি মোছা. শামীমা পারভীন। নারী হিসেবে বিশেষ সুযোগ নয় বরং কঠোর পরিশ্রম ও মেধা শক্তি দিয়ে এসপি মোছা. শামীমা পারভীন তার নেতৃত্বে শক্তিশালী একটি আইন-শৃঙ্খলা টিম গড়ে তুলেছেন রাজবাড়ী জেলা পুলিশ বাহিনীতে। অন্যায় ও অপরাধের কাছে আপোষহীন এসপি মোছা. শামীমা পারভীন অল্প কিছুদিনের মধ্যে জেলার ৫টি উপজেলা, ৩টি পৌরসভা ও ৪২টি ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের আস্তা ও ভালবাসা অর্জন করেছেন।


রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মারিয়া হক। ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে রাজবাড়ী সদর উপজেলা। যোগদানের পর থেকে রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন মারিয়া হক। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন সরেজমিন গিয়ে সততার সাথে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত এবং বাল্য বিয়ের হার বন্ধ করতে প্রতিনিয়ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় উঠান বৈঠক সহ বিভিন্ন সভা-সেমিনার চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাল্য বিয়ের কুফল ও মাদক বিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত। উপজেলার প্রান্তিক কৃষক ও সাধারণ মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগের কারণে সকলের ভরসার স্থল হয়ে উঠেছেন রাজবাড়ী সদর ইউএনও মারিয়া হক। নারী হিসেবে বিশেষ সুযোগ নয় বরং যে কোন কাজে চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত স্বার্বক্ষনিক।


গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এই নারীরা কেবল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সফল নয়, বরং ব্যক্তিগত জীবনেও তারা উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায় এবং দায়িত্ববোধের মাধ্যমে তারা এই উচ্চ পর্যায়ে পৌছেছেন। তাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ, যা তারা সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন।


রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিজ সুলতানা আক্তার বলেন, আজকের এই জায়গায় উঠে আসার ক্ষেত্রে পরিবারের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি। পরিবারের সহযোগিতা না থাকলে হয়ত এতদূর এগিয়ে আসা সম্ভব হতো না। তিনি বলেন, আমি রাজবাড়ী জেলায় বেশিদিন হয়নি যোগদান করেছি। আমার পূর্বে এই জেলায় আরোও ৫ জন নারী জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা সফলতা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি মনে করি এই জেলায় মেয়ে অফিসারের কাজ করার সুন্দর পরিবেশ আছে। তিনি বলেন, শুধু রাজবাড়ী নয় সারা বাংলাদেশে নারীরা এগিয়ে আছে। আমার বিশ্বাস যে জেলায় বিভিন্ন বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ যখন নারীরা নেতৃত্বে থাকে। তখন এই এলাকার নারীরা অনুসরন করবে। তাদের মধ্যেও স্বপ্ন আসে আমি অনেক বড় জায়গায় যাবো। নিসন্ধেহে এলাকায় পরিবর্তে নারী নেতৃত্বে একটি বড় ভূমিকা রাখবে।


রাজবাড়ী পুলিশ সুপার মোছা. শামীমা পারভীন বলেন, আমি কর্মের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য ও পার্থক্য খুঁজে পাই না। দায়িত্বের জায়গা থেকে কখনও নারী হিসেবে বিশেষ সুযোগ নিতে আগ্রহী নই। আমি পরিবারের মধ্যে কোন দিন বৈষম্যের শিকার হয়নি। তবে আমি বলবো উপরে উঠতে পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। সে নারী বা পুরুষ হোক। আমি নিজেও পরিশ্রম করে প্রতিযোগিতার মধ্যে এই দায়িত্বে এসেছি।


রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মারিয়া হক বলেন, গ্রামের একটি ছোট স্কুল থেকে উঠে এসেছি। এই পর্যন্ত উঠে আসতে পরিবারের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি। তিনি বলেন, একটি মেয়েকে উপড়ে উঠতে প্রথমে পরিবারের পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন। অনেক মেয়ে পরিবারের কারণে ঝড়ে পড়ছে। সুতরাং উপরে উঠে আসার ক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা থাকতে হবে। তিনি বলেন, নারীদের উপরে উঠে আসার ক্ষেত্রে প্রথমে বাঁধা পরিবার ও বাল্য বিয়ে। সুতরাং প্রত্যেকটি অভিভাবকের উচিত ছেলে-মেয়েকে সমান ভাবে মূল্যেয়ন করা।


ভবিষ্যতের দিশাঃ

রাজবাড়ী জেলায় নারীদের এই সফলতা অন্য জেলা ও সমাজের জন্য একটি উদাহরণ। তাদের নেতৃত্বে জেলার উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে, সেই সঙ্গে নারীদের ক্ষমতায়নও আরো দৃঢ় হবে। এই সফলতার গল্প প্রমাণ করে যে, নারীরা যে কোনো ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম, শুধু প্রয়োজন যথাযথ সুযোগ এবং সমর্থনের।