শবে মেরাজ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসমানে সফর

নিজস্ব প্রতিবেদক
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী- বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ
প্রকাশিত: রবিবার ২৬শে জানুয়ারী ২০২৫ ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন
শবে মেরাজ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসমানে সফর

শবে মেরাজ মুসলমানদের কাছে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাত, যা রজব মাসের ২৭ তারিখে সংঘটিত হয় বলে অনেকের ধারণা। যদিও এই তারিখ নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে, তবে মেরাজের ঘটনা কোরআন ও হাদীসে সুনিশ্চিত এবং ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। মেরাজের ঘটনাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এবং তারপর আসমানে ওঠার সফরকে উল্লেখ করে, যা তাঁর উম্মতের জন্য একটি মহামূল্যবান শিক্ষা।


কোরআন ও হাদীসে এই ঘটনা বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এক বিশেষ বাহন, বোরাকে করে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ে যান, এবং সেখান থেকে সপ্তম আসমান পর্যন্ত পৌঁছান। তারপর আল্লাহর দরবারে যাওয়ার পর ফিরে এসে ফজরের নামায আদায় করেন। মেরাজের এই সফরের সাথে সম্পর্কিত সব কিছু বিশ্বাসের বিষয়ে ঈমানদারদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত।


প্রথমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঘটনা সাথী সাহাবাদের কাছে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, তাঁর সাথে দু’জন ফেরেশতা এসে তাকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে আসমানে আরোহণ করে আল্লাহর দরবারে পৌঁছান। তিনি সেই সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করার আদেশ পান। তাঁর এই বিবরণ শুনে মক্কার কাফেররা অবিশ্বাস প্রকাশ করে, এটিকে কল্পনা এবং মিথ্যা বলে দাবি করতে থাকে।


মক্কার কাফেররা তখন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর কাছে গিয়ে এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করে। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. কোনো ধরনের সন্দেহ না করে বলেন, “তাহলে আমি বিশ্বাস করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যিই বলেছেন।” এর পরই তাকে সিদ্দীক (বিশ্বাসী) আখ্যা দেওয়া হয়।


এই ঘটনার পর কাফেররা আরও প্রশ্ন করতে থাকে, “বাইতুল মুকাদ্দাসের কতগুলি সিঁড়ি, জানালা ও দরজা আছে?” তারা নিশ্চিত করতে চায় যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই স্থানটি দেখেছেন কিনা। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এই সকল প্রশ্নের কোনো মানে ছিল না, কারণ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর নির্দেশাবলী অনুসরণ করা, এবং তা করতে গিয়ে তিনি স্বশরীরে মেরাজে গিয়েছিলেন।


তবে যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কাছে আরো একটি প্রমাণ আসল। আল্লাহপাক তাঁকে মেরাজের পুরো সফরের বিস্তারিত দেখিয়ে দেন। এই ঘটনা সম্পর্কে যখন কাফেররা সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, তখন তারা একে “যাদু” হিসেবে উল্লেখ করেছিল। তাদের এই অভ্যর্থনাও কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি, কারণ তারা আল্লাহর মর্জি না মেনে কিছুই বিশ্বাস করেনি।


এই ঘটনার পর মেরাজের মধ্য দিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে জ্যোতি ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টান্তে উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা সব মুসলমানের জন্য এক অনন্য শিক্ষা। তিনি আসমানে ওঠার পথে বিভিন্ন নবীগণের সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রথম আসমানে হযরত আদম আ. এর সাথে, দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা আ. ও ইয়াহইয়া আ., তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ আ., চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রীস আ. এবং আরও অনেকে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান।


আল্লাহর নির্দেশে, সপ্তম আসমানে পৌঁছানোর পর, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছান, যেখানে তাঁকে আরোহণের জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুমতি দেয়া হয়। সিদরাতুল মুনতাহা ছিল সেই স্থান, যেখানে ফেরেশতারা আর যেতে পারতেন না। এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাই আল্লাহর দরবারে পৌঁছান, যেখানে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাণী গ্রহণ করেন।


মেরাজের ঘটনা মুসলমানদের জন্য একটি শিক্ষা, যা ঈমানের শক্তি এবং আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শন সম্পর্কে বিশ্বাসে দৃঢ়তা আনে। এর মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবী ও আকাশের মাঝে আল্লাহর অসীম শক্তি, তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর রাজত্বের জ্ঞানে নতুন করে আকৃষ্ট হন। এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মেরাজের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আল্লাহর বিশেষ করুণা প্রকাশিত হয়েছিল।


মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে সাহায্য করুন। শবে মেরাজ আমাদের সবার জন্য আল্লাহর প্রেরিত শিক্ষা ও তাঁর ক্ষমার দিকে ফিরে যাওয়ার একটি মন্ত্রণা।