ওষুধের দোকান ছাড়া রেড জোনে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: রবিবার ৭ই জুন ২০২০ ১০:১৫ পূর্বাহ্ন
ওষুধের দোকান ছাড়া রেড জোনে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুপারিশ

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেশকে তিনটি জোনে ভাগ করে রোগী শনাক্ত, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং এবং চিকিৎসার সুপারিশ করেছে সরকারের গঠিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটি। যেসব শহর ক্লাস্টার রয়েছে, সেসব শহরকে রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। রেড জোনে ওষুধের দোকান ব্যতীত সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা বলা হয়। এ ছাড়া করোনার সংক্রমণের সব জোনে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং যারা মাস্ক ব্যবহার করবেন না, তাদের জরিমানার আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটির এক সদস্য গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা শহরভিত্তিক ক্লাস্টার লকডাউনের কথা বলেছি। করোনা সংক্রমণ রোধে আরবান এরিয়াকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে কার্যক্রম পরিচালানার একটি প্রস্তাবনা দিয়েছি। প্রস্তাবনায় বলেছি, যে এরিয়ায় ৪০ জনের বেশি করোনা শনাক্ত হবে, সেটিকে রেড জোন ঘোষণা করতে হবে। রোগীর সংখ্যা যদি ৪০-এর কম থাকে, তা হলে হবে ইয়েলো জোন। এই সংখ্যা সরকার হয়তো বাড়াতে বা কমাতে পারে। রোগীর সংখ্যা কী মহল্লা হিসেবে ধরা হবে, নাকি ক্যাচমেন্ট এরিয়া বা ওয়ার্ডভিত্তিক ধরবে, সেই ইউনিট ঠিক করতে হবে। ওয়ার্ড হিসেবে ৪০ জন ধরা হলে ঠিক হবে। বেশি এরিয়া নিয়ে ৪০ ধরলে হবে না। যেটি রেড জোন সেখানে ওষুধের দোকান ছাড়া সব বন্ধ থাকবে। রেড জোনে অন্য কোনো জোনের মানুষ ঢুকতে এবং বের হতে পারবে না। সেখানে যাদের পজিটিভ তাদের হাসপাতালে নিতে হবে। যারা করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের হোম কোয়ারেন্টিন কনফার্ম করতে হবে। প্রয়োজন হলে খাবারও সরকার সরবরাহ করবে। তিনি বলেন, আমরা সব জোনে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে বলেছি। কেউ মাস্ক না পরলে তাকে জরিমানার আওতায় আনতে বলেছি। এসব প্রস্তাবনা ঠিকমতো পালন করা হলে রেড জোনের সংক্রমণ কমে এক সময় ইয়েলো জোনে যাবে। ইয়েলো হবে জোন গ্রিন জোন। আমাদের প্রস্তাবনায় কোন জোনে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ঢাকা মহানগরের ওয়ার্ডভিত্তিক ম্যাপ করে জোনিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। যদি দেখা যায় কোনো ওয়ার্ডে ৪০ জন রোগী পাওয়া যাবে, সেটিকে রেড জোন ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া সারাদেশের জেলা-উপজেলাকে ম্যাপিংয়ের আওতায় আনা হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হয়। এসব রোগী ছিল ঢাকা ও মাদারীপুর জেলার। প্রথমদিকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও মাদারীপুর ক্লাস্টার এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংক্রমণ রোধে ক্লাস্টার এরিয়া লকডাউন করে স্থানীয় প্রশাসন। লকডাউনের পর ক্লাস্টার এরিয়া মাদারীপুরে সংক্রমণ বিস্তার বেশি না হলেও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এর পর ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মানুষ বিভিন্ন স্থানে গমন করায় সেখানে সংক্রমণ ছড়াতে থাকে। এভাবেই একের পর এক জেলায় সংক্রমণ বিস্তার করতে দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে অনেক ক্লাস্টার এরিয়া রয়েছে। যেসব এরিয়াকে রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হবে।

আইইডিসিআরের তথ্যমতে, করোনার সংক্রমণ বেশি হচ্ছে রাজধানীতে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, গাজীপুর ও কক্সবাজার জেলা। স্থানীয় প্রশাসন ইতোমধ্যে কক্সবাজারকে রেড জোন ঘোষণা করেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটি যে পরামর্শ দিয়েছে, সেই পরামর্শ অনুযায়ী রাজধানী ও এর বাইরে অনেক শহর রেড জোনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হবে।

দু’একদিনের মধ্যে ঢাকার কিছু স্থানে জোনিং কার্র্যক্রম শুরু হতে পারে। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হচ্ছে মিরপুরে, ৬০২ জন। এর পরই আছে উত্তরায় ৪৩৩ জন, মুগদায় ৪২৮, মোহাম্মদপরে ৩৯৪, যাত্রবাড়ীতে ৩৮৭, কাকরাইলে ৩০০, ধানমন্ডিতে ২৯৪, মগবাজারে ২৫৫, তেজগাঁওয়ে ২৫১, রাজারবাগে ২২১, খিলগাঁওয়ে ২১৯, লালবাগে ২০৬, বাড্ডায় ১৯৫, মালিবাগে ১৬৪, বাবুবাজারে ১৬২, গে-ারিয়ায় ১৪২, ওয়ারীতে ১২৪, বংশালে ১০৯ জন রয়েছে। এসব জেলায়ও সংক্রমণের শীর্ষ এলাকা ধরে চিহ্নিত হতে পারে রেড জোন।

করোনা ভাইরাস দেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়েছে। তবে এর সংক্রমণ কোনো জেলায় বেশি এবং কোনো জেলায় কম। দেশব্যাপী করোনা সংক্রমণের লাগাম টানতে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ, মৃদু ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঝুঁকিমুক্ত অঞ্চলগুলোকে আলাদা জোনে বিভক্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে। করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে গঠিত সরকারের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির এক সদস্য বলেন, করোনার সংক্রমণ সারাদেশে এক রকম নয়। কোনো অঞ্চলে বেশি আবার কোনো অঞ্চলে কম। করোনা প্রাদুর্ভাবের ওপর ভিত্তি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে ভাগ করে সংক্রমণ রোধের ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছি। যে এলাকায় সংক্রমণ বেশি, সেটিকে রেড জোন ঘোষণা করে সেখানে লকডাউন দিয়ে বেশি করে পরীক্ষা করা, পরীক্ষায় যাদের পজিটিভ পাওয়া যাবে, তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন, তাদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হবে। একই সঙ্গে রেড জোনের কোনো মানুষ অন্য জোনে যেতে পারবে না, অন্য জোনের মানুষ রেড জোনে যেতে পারবে না।

জানা গেছে, জাতীয় পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশকে রেড জোন, ইয়েলো জোন ও গ্রিন জোনে বিভক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। এর পরই এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তা ঠিক করতে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় গৃহীত স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের লক্ষ্য গঠিত ৮ সদস্যের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে মতামত চাওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞ কমিটি জোনভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে গত মঙ্গলবার রাতে বৈঠকে বসেন। আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সংক্রমণের হার বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিকভাবে আরবান ক্লাস্টার এরিয়াকে বিভিন্ন জোনে বিভক্ত করার একটি প্রস্তাব বুধবার সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দাখিল করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাবিত জোনিং খসড়া নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওই দিন বৈঠক করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ প্রস্তাবনার ওপর আরও কিছু অবজারভেশন দেন। এর পর এটি বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে ফেরত পাঠানো হয়। কমিটি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অবজারভেশনগুলো সমন্বয় করে প্রস্তাবনাটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠান।