
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:২৭

শুধু গুলিস্তান-মতিঝিলের ফুটপাত থেকেই প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৬ লাখ টাকা চাঁদা পেতেন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। সেই হিসাবে এই দুই এলাকার ফুটপাত থেকে বছরে চাঁদাবাজির ২৮ কোটি ৮ লাখ টাকা যেত সম্রাটের কাছে।এছাড়া গুলিস্তানের ছয়টি মার্কেট থেকে তোলা চাঁদার টাকাও যেত সম্রাটের কাছে। আর মতিঝিলের ছয়টি ক্লাব থেকে প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৫০ লাখ টাকা চাঁদা পেতেন তিনি।
সম্রাট এসব টাকার ভাগ দিতেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের অন্তত ২৫ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে। রিমান্ডে সম্রাটকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন র্যাবের কর্মকর্তারা।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, সম্রাটের হয়ে চাঁদাবাজির এসব টাকার হিসাব-নিকাশ করতেন তার সহযোগী এনামুল হক আরমান। পরবর্তীতে আরমান সেই টাকার ভাগ পৌঁছে দিতেন ২৫ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে। এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে সেই ২৫ জনের নামই প্রকাশ করেছেন সম্রাট।
নজরদারিতে সেই ২৫ প্রভাবশালী
র্যাবের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, সম্রাট জিজ্ঞাসাবাদে যে ২৫ প্রভাবশালীর নাম প্রকাশ করেছে, তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম-পরিচয় এখন জানানো হচ্ছে না। তবে তাদের সবাইকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, সম্রাট অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিচ্ছেন এবং অনেকের নামও বলেছেন৷ এসব তথ্য যাচাই–বাছাই করে দেখা হচ্ছে৷ তদন্তের স্বার্থে নামগুলো এখন প্রকাশ করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, রমনা থানায় করা অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলায় সম্রাট ১০ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। র্যাব-১ কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে৷ অন্যদিকে পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে আরমানকে সোমবার আবার রিমান্ডের আবেদন জানানো হলে, আরো পাঁচদিন রিমান্ডের অনুমতি পাওয়া গেছে।
মানুষকে ভয় দেখিয়ে ক্যাসিনো পরিচালনা, সরকারি জমিতে অবৈধ মার্কেট নির্মাণ, নতুন নির্মাণাধীন ভবনে চাঁদা আদায়, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও টেন্ডারবাজি করার জন্য সহযোগীদের নিয়ে অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন সম্রাট। অনেক ভুক্তভোগী অস্ত্রের ভয়ে চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট স্বীকার করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট জানিয়েছে, সে ও তার সহযোগীদের কাছে ১৪টি একে-২২, কাটা রাইফেল ৫টি, ছোট ও বড় রিভলবার ৩০টি এবং একটি অত্যাধুনিক একে-৪৭ রয়েছে। অস্ত্রগুলো তিনি যশোরের বেনাপোল ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর সীমান্ত এলাকা থেকে সংগ্রহ করেছেন।
জিসানের কাছে অস্ত্র সংগ্রহের পরামর্শ পান সম্রাট

সম্রাটের সঙ্গে একাধিক অস্ত্র চোরাকারবারীর সখ্য গড়ে উঠেছিল। এছাড়া ঢাকায় যুবলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করার পরই আন্ডারওয়ার্ল্ডের একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে।
এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর মধ্যে জিসান অন্যতম, যাকে এরই মধ্যে দুবাই পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জিসান মালিবাগ ও রমনা এলাকায় তার সাম্রাজ্য ধরে রাখার জন্য অবৈধ বিশাল অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট স্বীকার করেছেন যে তিনি জিসানের কাছ থেকেই অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের পরামর্শ পেয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর শুরুতে লোকজন নিয়ে কাকরাইলের কার্যালয়ে শো-ডাউন দিলেও পরে আড়ালে চলে যান সম্রাট। দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টায় ছিলেন তিনি। গত ৫ অক্টোবর ভোর ৫টার দিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রাম থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে সম্রাটকে নিয়ে দুপুর দেড়টার দিকে তার রাজধানীর কাকরাইলের কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় ভেতর থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, পিস্তল ও বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণীর চামড়া পাওয়া যায়। এ চামড়া রাখার দায়ে সম্রাটকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত। রোববার রাত পৌনে ৯টার দিকে সম্রাটকে কারাগারে নেয়া হয়। এছাড়া তার বিরুদ্ধে রমনা থানায় মাদক নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করা হয়। দুই মামলায় তাকে ১০ দিন করে মোট ২০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করে পুলিশ। এদিকে কারাগারে নেয়ার দু’দিন পর বুকে ব্যথা অনুভব করলে সম্রাটকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেয়া হয়। সেখানে চারদিন চিকিৎসা দিয়ে গত ১২ অক্টোবর আবার কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয় সম্রাটকে। পরদিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে সম্রাটের মা সায়েরা খাতুন দাবি করেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে তার ছেলেকে ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে’ এর মধ্যে জড়ানো হয়েছে।
গত ১৫ অক্টোবর ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে অস্ত্র ও মাদক মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। একই সঙ্গে তার সহযোগী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি এনামুল হক আরমানকেও মাদক মামলায় পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ১৭ অক্টোবর তাদের র্যাব-১ কার্যালয়ে নেয়া হয়।