খেকশিয়ালের সাথে বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ানের পরম সখ্যতা

নিজস্ব প্রতিবেদক
রিফাত হোসাইন সবুজ, জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ
প্রকাশিত: শুক্রবার ২৭শে আগস্ট ২০২১ ০৮:৪৫ অপরাহ্ন
খেকশিয়ালের সাথে বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ানের পরম সখ্যতা

লোকালয়ের কাছাকাছি বসবাস করা শিয়ালের সঙ্গে অন্য প্রাণীদের মত মানুষের তেমন সখ্যতা নেই। অরণ্য কেটে লোকালয় বাড়ার কারণে ক্রমেই এদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। তবে প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিয়ে খেকশিয়ালের সঙ্গে সখত্যা গড়ে তুলেছেন নওগাঁর বদলগাছীতে অবস্থিত পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সোমপুর মহাবিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু। 


ইতিহাস বিজরিত পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ভেতরে ডাকবাংলোর সামনে সন্ধ্যার পর প্রতিদিন অপেক্ষায় করে ১৫-২০ টি খেকশিয়ালের। পুরো বিহারজুড়ে প্রায় অর্ধশত খেকশিয়ালের বসবাস। মাটির ঢিবিতে গর্ত করে বসবাস করে থাকে এরা। গত বছর করোনা ভাইরাসের প্রপোক বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন এর কারনে শিয়ালগুলো অভুক্ত হয়ে পড়ে। খাবারের কারনে তার ডাকচিৎকারগুলো চরমভাবে ব্যথিত করে কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজুকে। 


তখন থেকেই শিয়ালগুলোর জন্য প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা শুরু করেন। সন্ধ্যা নামলেই এখানে শিয়ালের দল গর্ত থেকে দল বেঁধে বেরিয়ে আসে। জড়ো হয় পাহাড়পুরের ডাকবাংলোর সামনে। অপেক্ষা কখন আসবে খাবার দিতে ফজলুল করিম আরজু। কারণ প্রতিদিনই রাতে শিয়ালের জন্য খাবার নিয়ে হাজির হন তিনি। এভাবেই ধীরে ধীরে শিয়ালের সঙ্গে গড়ে উঠেছে পরম সখ্যতা। হাতে অনেক পাউরুটি ও রান্না করা খাবার নিয়ে ডাকবাংলোর সামনে এসেছেন পাহাড়পুর বিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু। সঙ্গে সঙ্গে শিয়ালের ডাকাডাকি। ডাক শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে সাড়ি সাড়ি শিয়ালগুলো। প্রায় প্রতিদিনের চিত্র এটি। মানুষের ভালোবাসায় এভাবেই তৈরি হয় প্রায় অসম্ভব এক সখ্যতা গড়ে তুলেছেন। যেন চোখ জুরানো দেখার মতো এক দৃশ্য। খেকশিয়াল এখন খুব কমই দেখা যায়। প্রায় বিলুপ্তির দিকে এই প্রাণী। 


পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী আরিফুল ইসলাম এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, সন্ধ্যা নামলেই খেকশিয়ালের ডাকাডাকি শুনতে পেলাম। এর দেখি এখানকার কর্মচারীরা খিুচরি ও রুটি নিয়ে যাচ্ছে বিহারের ডাকবাংলোর দিকে। তার পর কাস্টোডিয়ান আরজু সাহেব আয় বলে ডাক দিতেই অনেকগুলো শিয়াল কাছে চলে আসছে। তার হাতে থাকা খাবার তাদের খাওয়াচ্ছেন। শিয়ালগুলোর প্রতি এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রসংশার দাবি রাখে। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার এলকার স্থানীয় বাসিন্দা জয়দেব সাহা বলেন, কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজুর মহতি উদ্যোগের কারনে এদের কাউকেই অভুক্ত থাকতে হয়নি। করোনার লকডাউনের কারনে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল বিহারটি এবং লকডাউনের কারনে বাহিরের লকালয় থেকেও শিয়ালগুলো খাবার সংকটে পড়েছিল। গতবছর থেকে প্রতিদিন কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু শিয়ালগুলোতে খাবার দিয়ে থাকে। তার এমন উদ্যোগ সকলের নজর কড়েছে।


প্রতিদিন শিয়ালগুলোর রান্না করা হয় ভাত ও খিঁচুরি। এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করে আসছেন বিহারের সাইট পরিচালক মো: সারোয়ার হোসেন ও কেয়ারটেকার মো: মাসুম হোসেনসহ বিহারের কর্মচারীরা।




সাইট পরিচালক সারোয়ার হোসেন জানান, গতবছর  ( মার্চ ) লকডাউনের কারনে খাবার সংকটে পড়ে    শিয়ালগুলো। তখন সন্ধ্যা নামলেই খাবারের কারনে ডাকচিৎকার করতো। তখন কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু স্যার বললেন কি সমস্যা শিয়ালগুলোর এত ডাকচিৎকার করে কেন। তখন আমরা স্যারকে বললাম খাবারের জন্য মনে হয় তারা এমন করছে। তার পর স্যার বললেন এখন থেকে প্রতিদিন তাদের খাবার দেয়া হবে। চাল,ডাল,মাংশসহ যা খায় সেগুলোর ব্যবস্থা করো টাকা আমি দিবো। তার পর থেকেই প্রতিদিন খাবার স্যার নিজ হাতে তাদের খাবার দেয়। আমরা স্যারকে সহযোগিতা করে থাকি।


বিহারের কেয়ারটেকার মাসুম হোসেন বলেন, আমি প্রতিদিন শিয়ালগুলোর জন্য ভাত ও খিচুরী রান্না করি। তার পর স্যার তাদের খাবার জন্য ডাক দিলেই কাছে চলে আসে। প্রথম দিকে একটু ভয় লাগছিল যদি কামড় দেয় বা আক্রমন করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রকম কোন ঘটনা ঘটেনি। ডাকলেই খুব কাছে চলে আসে খাবারের জন্য।




পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহাররের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজুর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, শিয়ালগুলোকে সচারচর লোকায়নে জনসম্মুখে দেখা যায়না। করোনা ভাইরাসের কারনে লকডাউনে দীর্ঘদিন পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ও জাদুঘর বন্ধ ছিল। যার কারনে দর্শনার্থীদের আগমন ছিল না। দর্শনার্থীরা পিকনিক করে ফেলে রাখা অবশিষ্ঠ খাবার তারা রাতের ফেলা খেয়ে থাকতো। অন্যদিকে লকডাউনের কারনে বাহিরের খাবারও তারা ঠিকমত পায়নি। ফলে চরম খাবার সংকটে পড়েছিল খ্যাঁকশিয়ালগুলো। ক্ষুধার্ত শিয়ালগুলোর জন্য আলাদা করে চাল কিনে রান্না করা ভাত, খিচুড়ি, পাউরুটিসহ নানা রকমের খাবার  খেতে দেয়া হয় প্রতিদিন ।


তিনি আরো বলেন, তাদের খাবারের জন্য সরকারি কোন বাজেট নেই। আমার ব্যক্তিগত অর্থ থেকে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকি। এছাড়া বদলগাছী উপজেলার ইউএনও মহোদয়,এলিল্যান্ড এবং জয়পুরহাটে থেকে সেনাবাহিনীর একটি টিমও কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তবে আমি যতদিন এখানে দায়িত্ব পালন করবো তাদের খাবারের কোন সংকট হবেনা। আমি চলে যাবার পর নতুন করে যিনি দায়িত্বে আসবেন এখানে তাকেও অনুরোধ করে যাবে যাতে এই প্রাণীগুলোর প্রতি খেয়াল রাখেন। সকল প্রাণীকূলের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাদের প্রতি এমন ভালোসার বর্হি:প্রকাশ করতে পেরে  আমি নিজেও খুব আনন্দিত ও প্রশান্তি অনুভব করছি।

 

ইচ্ছা শক্তি পরম মায়া,মমতা ও ভালোবাসায় জয় করা অনেক কিছুই তারই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের কাস্টোডিয়ান ফজলুল করিম আরজু। তার এমন উদ্যোগ স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক প্রসংশা কুড়িয়েছেন। সুস্থ ও নিরাপদে থাকুক পৃথিবীর সকল প্রাণীকূল। এমনটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।