বিপাকে পড়ে বাংলাদেশের কথা মনে করেছে প্রতিবেশী ভারত। দেশটি সংকটের সময় দীর্ঘদিন পেঁয়াজ না দিলেও এবার দিতে চাইছে, অনেকটা গলার কাঁটা দূর করতে। কেননা, নিজেদের সংকটের সময় আমদানি করেছে চাহিদার সূক্ষ্ম হিসেব না করে, এখন তা পচে যাচ্ছে। দুয়েকদিন হয়েছে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ভারত। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংকটের সময় পণ্যটি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটি। আর এতে বাংলাদেশের বাজারে ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়ে পেঁয়াজের কেজি ২৮০ টাকায় পৌঁছে। অবশ্য ভারতের বাজারেও পেঁয়াজ সংকট ছিল তুমুল পর্যায়ে। রাজ্য ভেদে ১০০ রুপি কেজি ছাড়িয়ে যায় দাম।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় উভয় দেশ। এতে বাংলাদেশ পেঁয়াজের বাজারে চাহিদা অনুযায়ী আমদানি সমন্বয় করতে পারলেও পারেনি ভারত। রাজ্য সরকারের চাহিদা অনুযায়ী পেঁয়াজ আমদানি করে বিপাকে পড়ে গেছে কেন্দ্র। কারণ যে চাহিদ দিয়েছিল রাজ্য সরকার, আমদানির পর তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জমা পড়ে আছে পণ্য। এ হিসেবে সোমবার (১৩ জানুয়ারি) ভারতের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার রকিবুল হকের সঙ্গে বৈঠকে পেঁয়াজ কেনার প্রস্তাব দেন। এরপরই বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা ওঠে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য। তাই দ্রুত জমে থাকা পেঁয়াজ বাংলাদেশকে দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ভারত। দেশটি বিপদ থেকে উদ্ধার হতেই বাংলাদেশের কথা মনে করেছে। তবে বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে সাড়া দেবে কি-না, তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। এ জন্য সরকার আগামী কয়েক মাস দেশের পেঁয়াজ উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে পর্যালোচনা করে কতটুকু লাগবে, তা বের করবে। আমদানি করতে হবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের আমদানিকারক ও কৃষক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে সরকারকে। এরপর হয়তো আমদানি করতে পারে।
যদিও ভারত অফিসিয়ালি এ ধরনের কোনো প্রস্তাব দেয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বুধবার (১৬ জানুয়ারি) তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা অফিসিয়ালি পেঁয়াজ কেনার কোনো প্রস্তাব পাইনি। এছাড়া এটা আমাদের কনসিডারেশনও নেই। এছাড়া এ ধরনের প্রস্তাব আসলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে আসবে। মন্ত্রী বলেন, প্রস্তাব আসলে দেখে বিবেচনা করবো, কী ধরনের। কিন্তু আমরা তো এখন নিজেরাই সরাসরি আমদানি করছি। এরপরও যদি উপযুক্ত হয়, দেখা যাবে। বাট এখন আমাদের এটা কনসিডারেশনে নেই।
এরপর বুধবারই জাতীয় সংসদে নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় পেঁয়াজের দাম কমে আসবে। ১১০ টাকা কেজি থাকবে না। এছাড়া এখন পেঁয়াজের মৌসুমও।
ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রস্তাবের বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ভারত নিজেদের আমদানি করা পেঁয়াজ দিতে চাচ্ছে। কারণ পেঁয়াজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না। তবে আমাদের চাহিদার ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করতে হবে। আগামী মাসগুলোতে আমাদের পেঁয়াজের সরবরাহ থাকবে। এ হিসেবে তাদের পেঁয়াজ আনার সুযোগ আছে কি-না বিবেচনায় নিতে হবে। একইসঙ্গে এর গুণগতমান বিচারের পাশাপাশি তাদের দেশীয় পেঁয়াজ দেবে কি-না, সে শর্ত দিতে হবে। এছাড়া অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, বর্তমানে যারা বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছে, ও যারা উৎপাদন করছে, তারা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, আমাদের পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভর করতেই হবে। কারণ রাতারাতি উৎপাদন করে চাহিদা মেটানো যাবে না। এছাড়া আমাদের আমদানি করা পেঁয়াজের মধ্যের ভারতের গুলোরই চাহিদা বেশি। তিনি বলেন, এখনও আমাদের চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের সরবরাহ সীমিত। তবে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির আগে অবশ্যই আমাদের চাহিদা, সরবরাহ, মজুদ ও দেশীয় উৎপাদক শ্রেণি ও আমদানিকারকদের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে।
রাজধানীর শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, ভারতের আমদানি করা পেঁয়াজের টেম্পার নষ্ট হয়ে গেছে। মান এখন ভালো নেই। যখন প্রয়োজন ছিল, তখন তো তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে দেশের চাহিদা মিটিয়েছি। এখন যদি আবার ভারত থেকে মানহীন নষ্ট পেঁয়াজ কম দামে আনে, তাহলে দেশের আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এছাড়া এক মাস পর দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসবে। তখন দেশের কৃষকও পেঁয়াজের ন্যায্য দাম পাবে না।
সোমবারের বৈঠকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য প্রিন্ট’ প্রতিবেদনে বলেছে, বিভিন্ন রাজ্যের চাহিদার ভিত্তিতে পেঁয়াজ আমদানি করে বিপাকে পড়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার।
দ্য প্রিন্ট বলেছে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভারতের সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারত বিদেশ থেকে মোট ৩৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির চুক্তি করেছে। ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশটিতে ১৮ হাজার টন পেঁয়াজ পৌঁছেছে। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্য সরকার এই পেঁয়াজের মাত্র তিন হাজার টন নিয়েছে। বাকি পেঁয়াজ মুম্বাইয়ের জওহরলাল নেহরু বন্দরে খালাসের অপেক্ষায়। ভারত এসব পেঁয়াজ টন প্রতি ৫০ হাজার থেকে ৫৯ হাজার (৬০০ থেকে ৭০০ ডলারে) টাকায় আমদানি করেছে। যা এখন বাংলাদেশকে ৫৫০ থেকে ৫৮০ ডলার টন কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে মোদী সরকার।
এদিকে, ওই বৈঠকে প্রস্তাবের বিপরীতে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার রকিবুল হক বলেছিলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছে। একইসঙ্গে নেপাল হয়ে আরও পেঁয়াজ দেশের বাজারে ঢোকার অপেক্ষায়। সুতরাং পণ্যটি রপ্তানিতে বিনামূল্যে পরিবহনসহ কিছু প্রণোদনা দেওয়া উচিত ভারতের।
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।