
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ১৬:৩৫

চারশ’ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায় আগর-আতর শিল্প আজ একটি সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক খাতে পরিণত হয়েছে। সুজানগর ইউনিয়নকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই শিল্পের বিশাল ভিত্তি, যেখানে প্রতিটি ঘরের আঙিনায় আগর গাছ আর আতরের সুবাস যেন শিল্পবিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছে। মোঘল আমল থেকেই শুরু হওয়া এই শিল্প আজ দেশ পেরিয়ে বিশ্বজয় করছে।
সুজানগরের গ্রামীণ রাস্তায় হেঁটে গেলে চোখে পড়বে আগরগাছের সারি, কারখানার কর্মব্যস্ততা আর বাতাসে ভাসমান আতরের ঘ্রাণ। নারী-পুরুষ একত্রে অংশ নিচ্ছেন উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে, গাছ কাটা, ফালি করা, কাঠ জ্বালানো, নির্যাস সংগ্রহ এবং আতর উৎপাদন—সবকিছুই হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে। এই এলাকায় ছোট-বড় প্রায় প্রতিটি বাড়িই এখন একটি ক্ষুদ্র কারখানায় রূপ নিয়েছে।
২০১৩ সালে ক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে আগরের স্বীকৃতি এবং ২০১৪ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের পর এ অঞ্চলে বাণিজ্যিক আগর চাষের পরিমাণ বেড়েছে বহুগুণ। ২০২৪ সালে বড়লেখার আগর-আতর জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর কদর আরও বেড়েছে। প্রতি বছর এখান থেকে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার আগর-আতর রফতানি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, বড়লেখার আতরের মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্য হলেও ইউরোপের দেশগুলোতেও রফতানি হচ্ছে। সুগন্ধির বাজারে বাংলাদেশের এই ঐতিহ্যবাহী পণ্যটির চাহিদা অনেক বেশি, তবে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা ও প্রযুক্তির অভাবে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পর্যাপ্ত সহায়তা পেলে এই খাতটি রফতানির শীর্ষে উঠে আসবে বলেই মনে করছেন উদ্যোক্তারা।

বড়লেখার সালদিঘা, রফিনগর, হাসিমপুর, বড়থল এবং চিন্তাপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি আগরের চাষ হয়ে থাকে। প্রতিটি আগরগাছই মূল্যবান, বিশেষ করে পরিপক্ব গাছের কাঠের দাম প্রতি কেজি ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত প্রতি তোলা কাঁচা আতরের দাম ৬ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করে।
আগর ব্যবসায়ীরা জানান, তরল আতরের উৎপাদন থেকে শুরু করে কাঠ রপ্তানির কাজে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন। নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ এ শিল্পে নতুন মাত্রা এনেছে। স্থানীয়ভাবে আগর গাছের চারা উৎপাদন, পেরেক মারার দক্ষ শ্রমিক তৈরি এবং ছোট কারখানা স্থাপন করে বহু পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে।
তবে এই শিল্পের আরও বিকাশের জন্য সরকারিভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ আগর-আতর গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন, আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং রপ্তানি নীতিমালা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। মৌলভীবাজারের সম্ভাবনাময় এই শিল্প দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।