“আমি ভালো হতে পারলাম না, তাই নিজেই এই দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছি”—চিরকুটে এমন করুণ বার্তা লিখে চিরদিনের মতো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বিদায় নিয়েছে মেহেদী হাসান আপন (১৬) নামে এক কিশোর। সে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। ঘটনার পর থেকে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তার পরিবার, সহপাঠী ও এলাকাবাসীর মাঝে।
বৃহস্পতিবার (১৫ মে) রাত ৯টার দিকে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার পোগলদিঘা ইউনিয়নের বয়ড়া গ্রামে নিজ ঘরে দরজা বন্ধ করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে আপন। সে ওই গ্রামের ইটভাটার শ্রমিক শিপন মিয়ার ছেলে এবং বয়ড়া ইসরাইল আহমেদ উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।
অন্যদিকে আপনের আত্মহত্যার খবরে তার স্কুলের সহপাঠী, শিক্ষক ও প্রতিবেশীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সবাই তাকে একজন প্রাণবন্ত, হাসিখুশি ছেলে হিসেবে জানতেন। তার হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার দিন রাতে আপন প্রতিদিনের মতো খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ দাদার ঘরে অবস্থান করে। পরে সে একা নিজ কক্ষে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘক্ষণ কোনো সাড়া না পাওয়ায় তার মা ডাকাডাকি শুরু করেন। একপর্যায়ে ঘরের দরজা না খোলায় পরিবারের সদস্যরা দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তাকে ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান। পাশে পড়ে ছিল একটি দুই পৃষ্ঠার চিরকুট।
চিরকুটে লেখা কথাগুলো যে কোনো সংবেদনশীল মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। সেখানে নিজের প্রতি অপরাধবোধ, আত্মগ্লানি, এবং বাবা-মা ও পরিবারের প্রতি গভীর ভালোবাসার পাশাপাশি চরম হতাশার বহিঃপ্রকাশ উঠে এসেছে।
“শুরুতেই বলি সালাম নিবেন। আমি আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি, ক্ষতি করেছি, খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি ছোট থেকেই খারাপ, নিজেকে কখনও ভালো করতে পারিনি। বাবার কথা রাখতে পারিনি, তাঁর মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি।
বাবা, আপনার পা দুটি ধরে মাফ চাইতে পারলাম না। আমাকে মাফ করে দিয়েন। মা, তুমি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছো, অনেক বুঝিয়েছো; তবুও ভালো হতে পারলাম না। দাদার সম্মানও আমার জন্য হারিয়ে গেছে। আমি সবার মনে কষ্ট দিয়েছি।
বন্ধুদের বলি—তোদের সঙ্গে কত আড্ডা, কত আনন্দ করেছি। আমার কোনো কথায় কিছু মনে করিস না। আমার জানাজায় আসিস, আমার কবরে মাটি দিবি।
আমার কাছে যদি কেউ টাকা পেয়ে থাকে, তবে আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি ভালো হতে পারিনি, তাই নিজেই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছি। আপনারা ভালো থাকবেন। আপনাদের খারাপ সন্তান আর নেই।
ইতি—আপনাদের খারাপ ছেলে, আপন।”
নিহতের ছোট বোন আছিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “ভাইয়া রাতে খেয়ে দাদার ঘরে গিয়েছিল। পরে সে নিজ ঘরে যায়। মা কাজ থেকে ফিরে এসে ডাকাডাকি করতে থাকেন, কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ভাইয়াকে ঝুলন্ত অবস্থায় পান।”
খবর পেয়ে সরিষাবাড়ী থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্থানীয়দের সহায়তায় মরদেহ উদ্ধার করে এবং প্রাথমিক সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে।
এ বিষয়ে সরিষাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাশেদ মিয়া বলেন, “খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করি। ঘটনাস্থলে পাওয়া চিরকুটে আত্মহত্যার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। মরদেহের সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”