পবিত্র কোরআনের সুরা কাহফে আল্লাহ তাআলা বেশ কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনার কথা বলেছেন। এর মধ্যে একটি আসহাবে কাহফের ঘটনা। এই ঘটনার নামেই মূলত সুরাটির নাম রাখা হয়। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি কুকুরের বীরোচিত ভূমিকার কথাও পবিত্র কোরআনে আলোচিত হয়েছে। কুকুর পোষার ব্যাপারে ইসলামের বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও পবিত্র কোরআনে কেন কুকুরটিকে এত গুরুত্ব দেওয়া হলো, কুকুরটি কি আসলেই জান্নাতে যাবে এবং এই কুকুরের ঘটনা থেকে আমাদের জন্য কী শেখার আছে—এসব জিজ্ঞাসা নিয়েই আজ আমি হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকীর এই লেখা।
আসহাবে কাহফ কারা
আরবি ‘আসহাবুল কাহফ’ শব্দের অর্থ গুহাবাসী। পবিত্র কোরআনে এমন একদল যুবককে আসহাবুল কাহফ বলা হয়েছে, যাঁরা একজন খোদাদ্রোহী অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে বাঁচতে এবং নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদত করতে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁদের বিশেষ ব্যবস্থায় সুরক্ষা দেন এবং ৩০০ বছর পর্যন্ত তাঁদের ঘুমন্ত অবস্থায় রাখেন। এরপর তাঁদের ফের জাগিয়ে দেন এবং সেকালের মানুষের জন্য এক বিস্ময়কর ঘটনা ও নিদর্শন বানান।
সুরা কাহফের ১৪টি আয়াতে আসহাবে কাহফের আলোচনা এসেছে। সেই আলোচনায় যুবকদের সংখ্যা এবং তাঁরা কত দিন সেই গুহায় ঘুমিয়ে ছিলেন তা এসেছে। তবে ঘটনাটি কখন ঘটেছিল এবং কোথায় ঘটেছিল—এ ব্যাপারে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। যুবকদের সংখ্যা সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর যুগের মানুষের তিনটি মতের কথা বলা হয়েছে—তিনজন, পাঁচজন ও সাতজন। এরপর বলা হয়েছে, আসল সংখ্যা আল্লাহই ভালো জানেন।
এ ঘটনা কখন হয়েছিল, তা নিয়েও ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। কোনো কোনো আলেম বলেছেন, ইসা (আ.)-এর জন্মের আগেই পুরো ঘটনাটি ঘটেছিল। কেউ বলেছেন, গুহায় আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ইসা (আ.)-এর জন্মের আগের হলেও ফের জেগে ওঠার ঘটনা তাঁর জন্মের পর। কেউ কেউ পুরো ঘটনাই ইসা (আ.)-এর জন্মের পর বলে মত দিয়েছেন। কেউ বলেছেন, মহানবী (সা.)-এর জন্মের মাত্র কুড়ি বছর আগেই তাঁরা জেগে উঠেছিলেন। তবে দাকয়ানুস নামের অত্যাচারী রোমান সম্রাটের আমলেই এ ঘটনার সূচনা বলে সকলে মনে করেন।
ঘটনাটি কোথায় ঘটেছিল, তা নিয়ে দুটি মত রয়েছে। বেশির ভাগ মুফাসসির বলেছেন, ঘটনা জর্ডানের প্রাচীন নগরী পেত্রায় ঘটেছিল। কেউ বলেছেন, তুরস্কের ইজমিরে।
কুকুরটি সম্পর্কে কোরআনে যা বলা হয়েছে
আসহাবে কাহফের ঘটনায় কুকুরটির কথা মোট চারবার এসেছে। যেমন, এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি মনে করবে—তারা সজাগ, অথচ তারা ছিল ঘুমন্ত, আমি তাদের ডানে-বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম। আর তাদের কুকুরটি গুহার দরজার সামনে তার সামনের পা দুটি প্রসারিত করে ছিল। তুমি যদি তাদের দেখতে, তাহলে অবশ্যই পেছন ফিরে পালিয়ে যেতে, আর অবশ্যই আতঙ্কিত হয়ে পড়তে।’ (সুরা কাহফ: ১৮)
এ আয়াতে আসহাবে কাহফের ঘটনায় কুকুরটির মূল ভূমিকার কথা উঠে এসেছে। মহান আল্লাহ গুহামুখের যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, তাতে কুকুরের পা ছড়িয়ে বসে থাকা ছিল অন্যতম। এ কারণেই কোনো কোনো মুফাসসির জন্তুটিকে কুকুর না বলে বাঘ আখ্যা দিয়েছেন। কারণ, কোরআনে উল্লিখিত আরবি ‘কালব’ শব্দটি বাঘ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তবে অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেন, সেটি কুকুরই ছিল; বাঘ ছিল না।
এরপর আসহাবে কাহফের সংখ্যার আলোচনায় আরও তিনবার কুকুরটির কথা এসেছে। যেমন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, কিছু লোক বলবে, তারা ছিল তিনজন, চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর। আর কিছু লোক বলবে, তারা ছিল পাঁচজন, ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর, অজানা বিষয়ে সন্দেহপূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে। আবার কিছু লোক বলবে, তারা ছিল সাতজন, আর অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলো, তাদের সংখ্যা সম্পর্কে আমার প্রতিপালকই বেশি জানেন। অল্প কয়জন ছাড়া তাদের সংখ্যা সম্পর্কে কেউ জানে না। কাজেই সাধারণ কথাবার্তা ছাড়া তাদের ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক করো না, আর তাদের সম্পর্কে কারও কাছে কিছু জিজ্ঞেসও করো না। (সুরা কাহফ: ২২)
এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, দলের সদস্য যত জনই হোন, কুকুরটি যে ছিল, তাতে কারও দ্বিমত নেই।
কুকুরটি সম্পর্কে মুফাসসিরগণ যা বলেছেন
কুকুরটির গায়ের রং ও নাম সম্পর্কে তাফসিরে বিভিন্ন বক্তব্য এসেছে। মুতাকিল বলেছেন, কুকুরটি ছিল হলুদ রঙের। কুরতুবি বলেছেন, হলুদে লালের মিশেল ছিল। কেউ কেউ বলেছেন, পাথরের রঙের ছিল। অধিকাংশ মুফাসসির কুকুরটির নাম ‘কিতমির’ বলেছেন। আলি (রা.) বলেছেন ‘রাইয়ান’। এ ছাড়া ‘তাকুর’, ‘সাহবা’, ‘কাতমুর’ ইত্যাদি নামও এসেছে।
কুকুরটি কীভাবে আসহাবে কাহফের সঙ্গে যুক্ত হলো এ বিষয়ে মুফাসসিরগণ বলেন, কুকুরটির মালিক ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। কেউ কেউ বলেছেন, সেকালের রাজার বাবুর্চি।
কৃষক হোন বা বাবুর্চি—আসহাবে কাহফের সদস্যরা যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনিও তাদের সঙ্গে রওনা হন। কারণ তিনিও সত্য ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ফলে কুকুরটিও তাঁদের পিছু নেয়। কোনো কোনো তাফসিরে কুকুরটির মানুষের মতো কথোপকথনের আলাপও এসেছে। যাই হোক, কুকুরটি যে আল্লাহর বিশেষ রহমত হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কুকুরটি কি আসলেই জান্নাতে যাবে
তাফসিরে আবুস সউদ, তাফসিরে মাজহারি, তাফসিরে রুহুল মাআনিসহ বেশ কিছু তাফসির গ্রন্থে প্রখ্যাত তাবেয়ি খালেদ ইবনে মাদান (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে আসহাবে কাহফের কুকুর জান্নাতে যাবে বলা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আসহাবে কাহফের কুকুর ও বালআম বাউরের গাধা ছাড়া কোনো চতুষ্পদ জন্তু জান্নাতে যাবে না।’
আসহাবে কাহফের কুকুরটি যে সম্মানিত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই কুকুরের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন।
তাহলে কি কুকুর পোষা জায়েজ
আসহাবে কাহফের কুকুরকে মর্যাদা দেওয়া হলেও ইসলামে শখের বশে কুকুর পোষা বৈধ নয়। কারণ ইসলামে শখ করে কুকুর পালন করা নিষেধ। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ঘরে কুকুর আছে, সে ঘরে রহমতের ফেরেশতারা প্রবেশ করেন না।’ (বুখারি) তবে শিকার করা, ফসলের সুরক্ষা, পশুপাখির নিরাপত্তা, ঘরবাড়ি, দোকান ও অফিস পাহারা দেওয়া এবং অপরাধী চিহ্নিত করার জন্য কুকুর পোষা বৈধ। (মুসলিম, তিরমিজি, ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ৪ / ২৪২)
মুফাসসিরগণ বলেন, আসহাবে কাহফের কুকুরকে মর্যাদাবান সাব্যস্ত করতে ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ সেটি ছিল কৃষক বা বাবুর্চির সম্পদ সুরক্ষার জন্য পোষা কুকুর, যা ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ নয়। কেউ কেউ বলেছেন, কুকুরটি আসহাবে কাহফের সম্পদ সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ছিল। ফলে তা শখের বশে পালিত কুকুর নয়। কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন, শখের বশে পালিত হলেও সমস্যা নেই। কারণ, তা ইসলামপূর্ব যুগের। তখন কুকুর পোষার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি।
আসহাবে কাহফের কুকুর থেকে যা শেখার আছে
কুকুর হয়েও পবিত্র কোরআনে সম্মানজনক আলোচনায় আসা নিঃসন্দেহে গৌরবের। তাই এ ঘটনা থেকে আমাদের শেখার বিষয় হলো—সৎসঙ্গে স্বর্গে বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। অর্থাৎ, ভালো মানুষের সঙ্গে চললে ভালো হওয়া যায়। খারাপ মানুষের সঙ্গে চললে অপরাধে জড়াতে হয়। আল্লাহর খাস বান্দাদের সান্নিধ্য নিলে তাঁদের মতো হওয়ার সুযোগ মেলে এবং পাপীদের দলে ভিড়লে অপরাধের গহ্বরে হারিয়ে যেতে হয়। তাই আমাদের উচিত, মুত্তাকিদের দলে নিজেদের নাম লেখানো, তাঁদের সান্নিধ্যে সময় কাটানো এবং তাঁদের দেখানো পথে জীবন পরিচালিত করা।
বিখ্যাত তাবেয়ি ইবনে আতিয়া বলেছেন, ‘নেককার মানুষকে যারা পছন্দ করে, তারা তাদের কল্যাণ লাভ করে। একটি কুকুর নেককার বান্দাদের ভালোবাসলো এবং তাঁদের সঙ্গ দিল, আল্লাহ তাআলা তাঁর নামও পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করে দিলেন।’ তাই মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যাকে ভালোবাসবে, তার সঙ্গেই তোমার হাশর হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।