আশাশুনি উপজেলার উপকূলীয় এলাকার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা তৈরি করেছে। পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খুলনা ও সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে আগামীদিনে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে, আশাশুনি, শ্যামনগর এবং বাগেরহাট জেলায় সাইক্লোন এবং জলোচ্ছ্বাসের শক্তি বাড়তে পারে। এজন্য এখন থেকেই উপকূলীয় বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিগত কয়েকশ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৫০টি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, যার ফলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ১৫৮৪ সালে বাংলাদেশের বাকেরগঞ্জে একটি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, যা ২ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ১৮২২ সালে ৬ জুন, ১৮৬৯ সালের ১৬ এপ্রিল, এবং ১৮৭৬ সালে ভোলাসহ বিভিন্ন উপকূলে ঘটেছিল বড় জলোচ্ছ্বাস, যাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
এরপর ১৯৬০ সালে বাংলাদেশে অনেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, যার মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী ছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সৃষ্ট এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল এবং বিপুল পরিমাণ ফসল, গবাদি পশু এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। ২০০৭ সালের সিডর ও ২০০৯ সালে আইলা, ২০১৩ সালে মাহাসেন, ২০১৫ সালে কোমেন, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৭ সালে মোরা, ২০১৯ সালে ফণী, বুলবুল এবং ২০২০ সালে আমফান - এসব ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবেও দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন, নদী পথে নাব্যতার সংকট, উপকূলীয় বনাঞ্চলের অবক্ষয়, এবং স্থানীয়ভাবে গাছপালা কর্তন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের জলস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, ভারী বৃষ্টিপাত, তীব্র বাতাসের সৃষ্টি এবং সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের শক্তি বাড়তে পারে।
এই পরিস্থিতিতে আশাশুনি, শ্যামনগর ও বাগেরহাটসহ সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলগুলির জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বেড়িবাঁধগুলো পুনরুদ্ধার ও শক্তিশালী করার পাশাপাশি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ, উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, “এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে যদি যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।”
স্থানীয় মৎস্য বন্দর মহিপুরের এক জেলে আব্দুর রহিম বলেন, “আমরা এখনো সিডরের ভয়াবহতা ভুলতে পারিনি। ওই সময় সবকিছু পানির নিচে চলে গিয়েছিল। এখন পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে আবারও এমন ঘটনা ঘটতে পারে, এজন্য প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।”
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বাসিন্দা আজিমন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলে ঝুঁকি বাড়ছে। আগে যা ঘটেছে, তা আর কোনোভাবেই পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া উচিত নয়।”
অপরদিকে, পরিবেশবাদীরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। বিশেষ করে, গাছপালা রক্ষার মাধ্যমে ভূমি ক্ষয় রোধ, নদী পথের নাব্যতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রয়োগের উপর জোর দেওয়া উচিত।
এ সময় উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের জানানো হয়েছে, তারা যেন নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিপদের সময়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় এবং ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য প্রস্তুতি নেন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।