যে ঈমান ও আদর্শে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলেন সাহাবারা

নিজস্ব প্রতিবেদক
ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ৫ই ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:৫০ পূর্বাহ্ন
যে ঈমান ও আদর্শে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলেন সাহাবারা

ইসলামের সোনালী যুগের ইতিহাস ও ঈমানের তেজোদ্দীপ্ত ঘটনা মুসলমানদের অনুপ্রেরণা লাভের অন্যতম মাধ্যম। যে ইতিহাস ও ঘটনা মুমিন মুসলমানের ঈমানকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

এ কারণেই আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে বিভিন্ন ঘটনাবহুল অনেক সুরা ঈমানদারদের জন্য বর্ণনা করেছেন। আগের নবি-রাসুলদের বিভিন্ন ঘটনাও তুলে ধরেছেন।

প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর খোলাফায়ে রাশেদার যুগেও ঘটেছে ঈমানের তেজোদ্দীপ্ত আশ্চর্যজনক অনেক ঘটনা। যাতে রয়েছে ঈমানদারদের জন্য অনুপ্রেরণা।

আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন। সে অভিযানে সেনাপতির দায়িত্ব পেয়েছিলেন বয়স তরুণ হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু।

ঘটনাচক্রে তিনি মুসলিম সৈন্যদলসহ রোম সাম্রাজ্যের বিশাল বাহিনীর হাতে বন্দি হন। মুসলিম সেনাপতিসহ বন্দিদের সবাইকে সম্রাটের সামনে হাজির করা হয়।

রোম সম্রাটের সঙ্গে মুসলিম সেনাপতির তেজোদ্দীপ্ত ঈমানি ঘটনা ঘটে। যে ঘটনা ও কথপোকথনে রোম সম্রাট মুসলিম সেনাপতিসহ যুদ্ধে অশংগ্রহণকারী সাহাবাদের মুক্তি করে দেয়। আর তাহলো-

রোম সম্রাট ছিলেন খ্রিস্টান। রাজদরবারে সম্রাটের সামনে তাদের হাজির করা হয়। সম্রাট ইসলামের সেনাপতিকে দুটি প্রস্তাব দেয়। তার একটি লোভনীয় খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে তার রাজত্বে অংশীদার হওয়ার আর অন্যটি ভয়ংকর শাস্তির।

রোম সম্রাট ঘোষণা করেন, ‘যদি তুমি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করো তবে আমি আমার রাজত্বে তোমাকে অংশীদার করবো। সম্রাটের ধারণ ছিল- মরুবাসী তরুণ সেনাপতি হয়তো অর্থ-সম্পদ, প্রভাব ও ক্ষমতার লোভে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে।

কিন্তু রোম সম্রাটের এ কথাটি জানা ছিল না যে, ‘যিনি একবার বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন, কুরআনের আলো হৃদয়ে ধারণ করেন, সারা দুনিয়ার বিনিময়েও তাকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো যায় না।’

মুসলিম সেনাপতি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই দেরি না করে রোম সম্রাটের এ প্রস্তাব মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করে দেন।

রোম সম্রাটের জন্য এটি ছিল মারাত্মক অপমানজন বিষয়। রাগ ক্ষোভ ও লজ্জায় সম্রাট মুসলিম সেনাপতিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ও বর্ষা নিক্ষেপ করে বিবৎস মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেন।

ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত
রাজ দরবারে চলছে পিনপতন নিরবতা। সম্রাটের নির্দেশে প্রস্তুত ফাঁসির মঞ্চ। নিয়ে আসা হলো মুসলিম সেনাপতিকে।

মুসলিম সেনাপতির সামনে যখন কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যু নৃত্য করছিল, তখনও মুসলিম সেনাপতি তেজোদ্দীপ্ত ঈমানে অটল, অবিচল। তিনি মুচকি হাসছিলেন আর তার চোখ থেকে ঝরছিল অশ্রু। ভয়, অস্থিরতা, ব্যকুলতা ও দুশ্চিন্তার সামান্যতম চিহ্নও তার মাঝে নেই।

সিদ্ধান্ত পরিবর্তন
সম্রাট সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। তাঁকে অপমানিত করার শাস্তি হিসেবে ফাঁসি উপযুক্ত নয়। বরং আরও কঠোর ও কঠিন শাস্তি দিতে হবে। যা দেখে যে কারো হৃদয় কেঁপে ওঠবে। নিশ্চিত জ্ঞান হারাবে সাধারণ মানুষ।

ফাঁসির চেয়ে ভয়ংকর শাস্তি
সম্রাট পুনরায় নির্দেশ দিলেন, ‘একটি বড় পাত্রে পানি গরম কর।’ নির্দেশ মোতাবেক পানি গড়ম করা শুরু হয়। আর তাতে বড় পাত্রে পানি আগুনের তাপে টগবগ করতে শুরু করে।

মুসলিমদের এক সঙ্গীকে এ ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দেয়া হলো। তাকে ফুটন্ত পানিতে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তার হাড় থেকে গোশতগুলো মুহূর্তেই খশে যায়।

নির্যাতনের বিবৎস দৃশ্য মুসলিম সেনাপতিসহ সব সাথীরাই তা নিজ চোখে দেখে। তাতেও তাদের চেহারায় কোনো ভয় বা আতংকের লেশমাত্র নেই।

সম্রাট পুনরায় মুসলিম সেনাপতির উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন-
সেনাপতি! তুমি তোমার সঙ্গীর বিবৎস নির্যাতন দেখলে। এখনও সময় আছে তুমি তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ কর, না হলে তোমাকেও এ পরিণতিই ভোগ করতে হবে।

মুসলিম সেনাপতির ভাবলেশহীন উত্তর-
‘আমি ফুটন্ত পানিতেও প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু ইসলাম ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
এবার রোম সৈন্যরা মুসলিম সেনাপতিকে হাত-পা বেঁধে ফুটন্ত পানির পাত্রের কাছে নিয়ে আসে।

সম্রাটের সঙ্গে মুসলিম সেনাপতির কথপোকথন
মুসলিম সেনাপতিকে ফুটন্ত পানির পাত্রে ফেলে দেয়ার আগেই সম্রাটের একটি বিষয় স্মরণ হয়ে গেলো এবং তার সৈন্যদেরকে থামতে বললেন।

মুসলিম সেনাপতির কাছে জানতে চাইলেন-
‘যখন তোমাকে ফাঁসির মঞ্চের সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল। আমি তখন দেখেছিলাম, তুমি মুচকি হাসছো এবং তোমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। এর কারণ কী?

মুসলিম সেনাপতি বললেন-
‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমার একটি মাত্র প্রাণ। যদি আমার একশ’ প্রাণ থাকতো, তাহলে আমি প্রত্যেকটি প্রাণ এভাবেই আল্লাহর রাস্তায় বিসর্জন দিতাম।’

মুসলিম সেনাপতির এ আশ্চর্যজনক উত্তরে রোম সম্রাট অবাক হলেন। আর ভাবতে লাগলেন-
‘শ’ বার মৃত্যুকে হাসি মুখে বরণ করে নেয়ার মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির শাস্তি ‘মৃত্যু’ মোটেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। বরং তাকে বাঁচিয়ে রাখাই শ্রেয়।’

সম্রাট নড়েচড়ে বসলেন এবং বললেন-
‘হে মুসলিম সেনাপতি! তুমি আমার মস্তক চুম্বন করো। আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব।’

মুসলিম সেনাপতি বললেন-
‘হ্যাঁ’, আমি মস্তকে চুম্বন করতে রাজি আছি। তবে শর্ত হলো-
‘শুধু আমাকে নয়, যদি আমার সব সাথীকে মুক্তি দেয়া হয়, তবেই আমি এ প্রস্তাবে রাজি।’

মুসলিম সেনাপতির শর্তে রোম সম্রাট রাজি হয়ে গেলেন।

শর্ত মেনে নেয়ার পর মুসলিম সেনাপতি রোম সম্রাটের মস্তকে চুম্বন করে সব সাথীদের মুক্ত করে মদিনায় ফিরে আসলেন।

এ ছিলো তেজোদ্দীপ্ত ঈমানের অধিকারী হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু। যিনি বন্দিদশার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু নিজের ব্যাপারে কোনো লোভ বা শাস্তির ভয় করেননি। শুধু নিজের সুবিধার কথাও ভাবেননি।

ইসলামের মর্যাদা ও সুমহান আদর্শকে ভূলন্ঠিত করেননি। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করেননি।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ ঘটনায় ইসলামের সুমহান আদর্শ ও ঈমানের পরিচয় পেয়েছিলেন রোম সম্রাট ও সভাসদবর্গ।

অবশেষে…
মুসলিম সেনাপতি কাফেলা নিয়ে মদিনায় ফিরে আসলেন। আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে রোম সম্রাটের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা দিলেন।

আমিরুল মুমিনিন ঘটনা শুনে তিনি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহুর মস্তকে চুম্বন করলেন।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সুমহান আদর্শ ও নির্ভয় রোম সম্রাটের হিংস্র ও কঠোর মনোভাবকেও পরাভূত করেছিল। সেই ঈমানই মুসলিম উম্মাহর কামনা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তেজোদ্দীপ্ত ঈমানের আলোয় জীবন সাজানোর তাওফিক দান করুন। আমিন।

ইনিউজ ৭১/এম.আর