কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হাদিসে এ ইবাদতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। একটি হাদিসে এসেছে, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত ফাতিমা (রা.)-কে তাঁর কোরবানির নিকট উপস্থিত থাকতে বলেন এবং ইরশাদ করেন, কোরবানির প্রথম রক্তবিন্দু প্রবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তোমার গুনাহসমূূহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! এটা কি শুধু আহলে বাইতের জন্য নাকি সব মুসলিমের জন্য? তিনি উত্তরে ইরশাদ করেন, এ ফজিলত সব মুসলিমের জন্য।’ মুসনাদে বাজজার, আত্তারগিব ওয়াত্তারহিব।অন্যদিকে যার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এ ইবাদতটি পালন করে না তার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তির কোরবানির সামর্থ্য রয়েছে, কিন্তু কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ মুস্তাদরাকে হাকেম, আত্তারহিব।
সার কথা হলো, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত উম্মতের মধ্যে এ ইবাদত ‘তাওয়ারুস’ ও ‘তাওয়াতুর’-এর সঙ্গে চলমান রয়েছে এবং প্রতি বছর ‘শিয়ার’ রূপে (ইসলামের একটি প্রকাশ্য ও সম্মিলিতভাবে আদায়যোগ্য ইবাদত হিসেবে) তা আদায় করা হয়েছে। অতএব কেউ যদি মনে করে, কোরবানি ইবাদত নয় এবং ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে সে শরিয়ত অস্বীকারকারী। এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে, ইবাদতের মূল কথা হলো আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণা। তাই যে কোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দুটি বিষয় জরুরি- ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আদায় করা এবং শরিয়তের নির্দেশনা মোতাবেক মাসলা-মাসায়েল অনুযায়ী তা সম্পাদন করা। তাই এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় কোরবানির জরুরি কিছু মাসায়েল উপস্থাপিত হলো। রব্বুল আলামিন আমাদের একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় মাসায়েল অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ এ ইবাদতটি আদায় করার তাওফিক দিন।
কোরবানির প্রয়োজনীয় মাসলাসমূহ
* ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নর-নারীর কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ সম্পদ থাকবে তার কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা-অলঙ্কার, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, শৌখিন বা অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র- এ সবকিছুর মূল্য কোরবানির নিসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। দেখুন ইবনে মাজা, বাদায়ে, শামি, আলমগিরি।
* কোরবানির নিসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কোরবানির দিনগুলোয় থাকলেই তা ওয়াজিব হবে। দেখুন বাদায়েউস সানায়ে, রদুল মুহতার।
* নাবালেগ সন্তানাদি (তেমনি যে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নয়) নিসাবের মালিক হলেও তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। দেখুন বাদায়েউস সানায়ে, রদুল মুহতার।
* মুসাফিরের (যে ৪৮ মাইল দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে) কোরবানি করা ওয়াজিব নয়। দেখুন কাজিখান, বাদায়েউস সানায়ে, আদুররুল মুখতার।
* নাবালেগের পক্ষ থেকে কোরবানি দেওয়া অভিভাবকদের ওপর ওয়াজিব নয়; বরং মুস্তাহাব। দেখুন রদুল মুহতার।
* গরিব ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কোরবানির নিয়তে কোনো পশু কেনে তাহলে তা কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। দেখুন বাদায়েউস সানায়ে।
* মোট তিন দিন কোরবানি করা যায়। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে জিলহজের ১০ তারিখেই কোরবানি করা উত্তম। দেখুন মুয়াত্তা মালিক, বাদায়েউস সানায়ে, আলমগিরি।
কেউ যদি কোরবানির দিনগুলোয় ওয়াজিব কোরবানি দিতে না পারে তাহলে পরে তার ওপর কোরবানির উপযুক্ত একটি ভাগের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। দেখুন বাদায়েউস সানায়ে, কাজিখান।
যেসব এলাকার লোকের ওপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা জায়েজ নয়। বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামাজ না হয় তাহলে ঈদের নামাজের সময় অতিক্রমের পর প্রথম দিনেও তাদের কোরবানি করা জায়েজ। দেখুন বুখারি, কাজিখান, আদদুররুল মুখতার।
* ১০ ও ১১ জিলহজ দিবাগত রাতেও কোরবানি করা জায়েজ। তবে দিনে কোরবানি করাই ভালো। দেখুন মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, আদদুররুল মুখতার, কাজিখান, বাদায়েউস সানায়ে।
* কোরবানির দিনগুলোয় যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশু সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত অবস্থার চেয়ে কমে যায় তাহলে হ্রাস পরিমাণ মূল্যও সদকা করতে হবে। অবশ্যই পশু সদকা করা বা পশুর মূল্য সদকা করা উভয়টির এখতিয়ার রয়েছে। দেখুন বাদায়েউস সানায়ে, আদদুররুল মুখতার।
* উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন- হরিণ, বন্য গরু ইত্যাদি দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়। দেখুন কাজিখান, বাদায়েউস সানায়ে।
* যেসব পশু কোরবানি করা জায়েজ তার নর-মাদি সবই কোরবানি করা যায়। দেখুন কাজিখান, বাদায়েউস সানায়ে।
কোরবানির পশুর বয়সসীমা
উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি এক বছরের কিছু কমও হয় কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, তা দেখতে এক বছরের মতো তাহলে তা দ্বারাও কোরবানি করা জায়েজ।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।