সম্প্রতি যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত তাহলো ‘গণপিটুনি’। ইসলামে গণপিটুনি হারাম ও সবচেয়ে বড় গোনাহের কাজ। ইসলাম কোনোভাবেই গণপিটুনিকে সমর্থন করে না। তা চিরস্থায়ী জাহান্নামে নিক্ষেপ ও কঠিন শাস্তি ভোগের অন্যতম কারণও বটে। কোনো মানুষ যদি অপরাধী হয় তবে তার জন্য বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো ব্যক্তিকে অপরাধ করতে দেখলেই সবাই মিলে তাকে পেটাতে হবে কিংবা শাস্তি দিতে হবে, ইসলাম এমনটি সমর্থন করে না। বরং ইসলামে রয়েছে অপরাধের শাস্তি প্রদানের সুস্পষ্ট বিধান। আর অপরাধী কিংবা নিরাপরাদ যেই হোক না কেন, দেশের আইনেও কোনো মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা কিংবা যখম করার কোনো সুযোগ নেই। অথচ দেশব্যাপী মহাসমারোহে চলছে গণপিটুনি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। গণপিটুনিতে যারা যেভাবেই অংশগ্রহণ করুক না কেন, সবাই সমান অপরাধী। গণপিটুনি হারাম ও সবচেয়ে বড় গোনাহ। এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে রয়েছে সুস্পষ্ট বক্তব্য।
কুরআন হাদিসে গণপিটুনির শাস্তি ও বিধান
নিরাপরাধ মানুষের রক্ত আল্লাহর কাছে কত মূল্যবান তা পবিত্র কুরআনের আয়েতে সুস্পষ্টভাবে ওঠে এসেছে। নিরাপরাধ ব্যক্তি হত্যার পরিণামে আল্লাহ তাআলা অনেকগুলো শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘যারা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করবে, তার প্রতিদান হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে চিরস্থায়ী হবে। আর আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত হবেন, তাকে লানত (অভিশাপ) করবেন। আর তার জন্য কঠিন আজাব প্রস্তুত করে রাখবেন।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৯৩)
এ আয়াতে নিরাপরাধ মানুষের রক্তপাত তথা হত্যার শাস্তির ৫টি ধরণ উল্লেখ করেছেন। অথচ যার একটি উল্লেখ করাই যথেষ্ট ছিল। হত্যার শাস্তি যে জঘন্য তা প্রমাণেই আল্লাহ তাআলা এ সুস্পষ্ট তাগিদ দিয়েছেন। আর তাহলো-
>> হত্যার প্রতিদান হচ্ছে জাহান্নাম।
>> হত্যাকারী জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবেন।
>> আল্লাহ হত্যাকারীর ওপর রাগান্বিত হবেন।
>> আল্লাহ হত্যাকারীর প্রতি লানত তথা অভিশাপ দেবেন।
>> হত্যাকারীর জন্য থাকবে কঠিন শাস্তি।
- হাদিসে এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিরাপরাধ মানুষকে হত্যার অপরাধে আল্লাহ তাআলা সব অপরাধীকে এক সঙ্গে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
- অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘একজন মুমিনের রক্তের মূল্য কাবা ঘরের চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার।’
- বিদায় হজের ভাষণে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিন নিরাপরাধ ব্যক্তির রক্তের মূল্যের ব্যাপারে নসিহত করে বলেছেন, ‘৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানের সময়, মাস ও স্থান যতবেশি মূল্যবান; আল্লাহর কাছে মুমিন নিরাপরাধ ব্যক্তির রক্ত আরও বেশি মূল্যবান।’
‘যে ব্যক্তি গণপিটুনির শিকার ব্যক্তিকে একটি থাপ্পড় দেবে, সেও সমান অপরাধী। যে ব্যক্তি একটি লাথি মারবে সেও সমান অপরাধী। যে ব্যক্তি কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করবে, সেও সমান অপরাধী। আবার যে বা যারা সেখানে থেকে এ দৃশ্য দেখবে কিন্ত প্রতিরোধ করবে না তারাও সমান অপরাধী।’
এ গণপিটুনির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আল্লাহ তাআলা একসঙ্গে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু সাইদ খুদরি ও হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আসমান-জমিনের মধ্যে বসবাসকারী সবাই মিলিত হয়ে যদি একজন মুমিনকে মেরে ফেলার কাজে শরিক হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে উপুর করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (তিরমিজি)
এ হাদিসে আসমান-জমিনের মধ্যে বসবাসকারী বলতে কী বুঝানো হয়েছে? জমিনের অধিবাসী হলো সব মানুষ ও জিন এবং আসমানের অধিবাসী বলতে ফেরেশতাদের বুঝানো হয়েছে। যদি তারা সবাই কোনো একজন মানুষকে হত্যার কাজে লিপ্ত হয় তবে আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।
গণপিটুনির বিচারে হাদিসের ওপর হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমল-
হজরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহির বর্ণনায় এসেছে যে, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ৭ জন ব্যক্তিকে হত্যা করেছেন। তাদের ওপর কেসাস প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই ৭ ব্যক্তি একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল।
সে সময় মানুষ হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে অভিযোগ করেছিল যে, এ ৭ জনের কেউ হয়ত হাত কেটেছে, কেউ পা কেটেছে কিংবা কেউ সামান্য যখম করেছে। তাহলে কেন তাদের ৭ জনকে হত্যা করা হবে? (এ ৭ জনের বাড়ি ছিল ইয়েমেনের সানাআ)
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মানুষের এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে বলেছিলেন, ‘যদি (ইয়েমেনের রাজধানী) ‘সানাআ’র সব মানুষ মিলে হত্যা করতো তবে আমি সানাআ’র সব মানুষের ওপর কেসাসের হুকুম বাস্তবায়ন করতাম। অর্থাৎ সানাআ’র সব অধিবাসীকে হত্যা করতাম।’ (মুসান্নেফে আব্দুর রাজ্জাক, মুয়াত্তা মালেক)
মাজহাবের ইমাম, মুহাদ্দিসিনে কেরাম, মুফাসসিরিনে কেরাম ও সাহাবায়ে কেরামের মতামত-
হজরত ইবনে রুশদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি সব ইমাম, তাফসিরবিদ ও সাহাবাদের পক্ষ থেকে এ মত গ্রহণ করেছেন যে, ‘যদি এক সঙ্গে সারা পৃথিবীর হাজারো মানুষ তথা আসমান ও জমিনের সব অধিবাসী একত্রিত হয়ে কোনো একজন নিরাপরাধ মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে, তাহলে তাদের সবাইকে কেসাসের অপরাধে হত্যা করা হবে। আর সকলেই হবে সমান অপরাধী।’
সুতরাং গণপিটুনির বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকা জরুরি। কোথাও বাস দুর্ঘটনার শিকার হলো কিংবা চুরি সংঘটিত হলো আর তখন বাসের হেলপার, ড্রাইভার বা চোরকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হলো। এমনটি যেন না হয়। কেননা সব অপরাধের জন্যই বিচার ব্যবস্থা রয়েছে।
মনে রাখতে হবে
গণপিটুনি কোনো বিচার ব্যবস্থা কিংবা সমাধান নয়, বরং এটি মারাত্মক অপরাধ ও সবচেয়ে বড় গোনাহের কাজ। ইসলাম গণপিটুনিকে হারাম করেছেন। গণপিটুনিতে যে যত বেশি বা কম অপরাধ করুক কিংবা নিরব দর্শক হোক সবাই সমান অপরাধী। গণপিটুনিতে জড়িত কোনো মানুষই জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে না।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে অন্যায়ভাবে আইন হাতে তুলে নিয়ে কোনো মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। কুরআন ও হাদিসের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। গণপিটুনি হতে দেখলে তা থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচানোর উদ্যোগ গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।