মুখ ও কথার দ্বারা মানুষের মনোভাব ভালো কিংবা মন্দ; তা প্রকাশ পায়। নিয়ন্ত্রণহীন কথা ও মুখ অন্যায় সংঘটিত হওয়ার উৎস। মানুষের মুখ ও মুখের কথা ঠিক তো তার যাবতীয় বিষয় ঠিক। জেনা-ব্যভিচার প্রতিরোধে মুখ ও মুখের কথার ভূমিকা রয়েছে। মুখ ও মুখের কথার দ্বারাই তা সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ পায়। এ কারণেই মুখ ও কথা প্রসঙ্গে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন-
لَا يَسْتَقِيْمُ إِيْمَانُ عَبْدٍ حَتَّى يَسْتَقِيْمَ قَلْبُهُ، وَلَا يَسْتَقِيْمُ قَلْبُهُ حَتَّى يَسْتَقِيْمَ لِسَانُهُ.
‘কোন বান্দার ঈমান ঠিক হয় না যতক্ষণ না তার অন্তর ঠিক হয়। তেমনিভাবে কোন বান্দার অন্তর ঠিক হয় না যতক্ষণ না তার মুখ ঠিক হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ)
মানুষের চার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জেনা-ব্যভিচার প্রতিরোধে খুব বেশি ভূমিকা রাখে তন্মধ্যে মুখ এবং মুখের কথাও একটি। মুখ ও মুখের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ইসলামিক স্কলার ইয়াহইয়া ইবনে মুআজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
‘অন্তর হচ্ছে ডেগের (বড় পাতিলের) ন্যায়। তাতে যা রয়েছে অথবা দেয়া হয়েছে তাই রান্না হতে থাকবে। বাড়তি কিছু নয়। আর মুখ হচ্ছে চামচের ন্যায়। যখন কেউ কথা বলে তখন সে তার মনোভাবই ব্যক্ত করে। অন্য কিছু নয়। যেভাবে আপনি কোনো পাত্রে রাখা খাদ্যের স্বাদ জিহবা দিয়ে অনুভব করতে পারেন ঠিক তেমনিভাবে কারোর মনোভাব আপনি তার কথার মাধ্যমেই টের পাবেন।’
মানুষ সাধারণত মন মুখ ও লজ্জাস্থানের মাধ্যমেই জেনা-ব্যভিচারের মতো অঘটন বেশি ঘটায়। তাই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো যে, কোন জিনিস সাধারণত মানুষকে বেশির ভাগ জাহান্নামের সম্মুখীন করবে; তাতেও মুখের কথা ওঠে এসেছে। এ সম্পর্কে হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করা হলো- কোন কর্মটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। তিনি বললেন- আল্লাহভীতি, সদাচরণ ও উত্তম চরিত্র। আবার তাকে প্রশ্ন করা হলো, কোন কাজটি সবচাইতে বেশি পরিমাণ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। তখন তিনি বলেন-
الْفَمُ وَالْفَرْجُ
‘মুখ ও লজ্জাস্থান।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, মুসতাদরাকে হাকেম, আদাবুল মুফরাদ, বায়হাকি, ইবনে হিব্বান)
এ হাদিস থেকে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, কথার নিয়ন্ত্রণই জেনা-ব্যভিচার থেকে মুক্ত থাকার উপায়। অন্যথায় জাহান্নাম সুনিশ্চিত।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জান্নাতে যাওয়ার এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সহযোগী আমল বলে দেয়ার সময় আরো কিছু ভালো আমলের কথা বলেন। এমনকি তিনি সব ভালো কাজের মূল, কান্ড ও চূড়া সম্পর্কে বলার পর বলেন, ‘আমি কি তোমাকে এমন বিষয় সম্পর্কে বলবো যার উপর এ সবই নির্ভরশীল? আমি (মুয়াজ) বললাম, ‘হে আল্লাহর নবি! আপনি দয়া করে তা বলুন। এরপর তিনি নিজ জিহবা ধরে বললেন-
এটাকে (জিহ্বা/মুখ ও মুখের কথাকে) তুমি অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করবে।’
তখন আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর নবি! আমাদেরকে কথার জন্যও কি পাকড়াও করা হবে?তিনি বললেন, ‘তোমার কল্যাণ হোক! হে মুয়াজ! একমাত্র কথার কারণেই বিশেষভাবে সে দিন মানুষকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, বায়হাকি)
মুখ ও কথার উপকার-অপকার
মানুষের মুখ ও মুখের কথার কারণেই দুনিয়া ও পরকালের সব নেক আমল ধ্বংস হয়ে যাবে। এ বিষয়টিও ওঠে এসেছে হাদিসের বর্ণনায়-
হজরত জুন্দাব ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
হজরত জুন্দাব ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
‘এক ব্যক্তি বললো, আল্লাহর কসম! আল্লাহ তাআলা ওকে ক্ষমা করবেন না। তখন আল্লাহ তাআলা বললেন, ‘কে সে?
যে আমার উপর কসম খেয়ে বলে যে, আমি ওমুককে ক্ষমা করবো না। অতএব আল্লাহ তাআলা তাঁর উপর শপথকারীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমি ওকেই ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমার সব নেক আমল ধ্বংস করে দিলাম।’ (মুসলিম)
সুতরাং কখনো অযথা কথা বলা যাবে না। যদি কখনো অন্তরে কোনো কথা বলার ইচ্ছা জাগে; তাহলে আগেই চিন্তা করতে হবে যে, এ কথার দ্বারা কোনো ফায়েদা বা উপকারিতা আছে কিনা? যদি তাতে কোনো ধরনের ফায়দা বা উপকারিতা না থাকে তবে তা থেকে বিরত থাকা অর্থাৎ কোনো কথা না বলা।
আর যদি তাতে কোনো ধরনের ফায়দা বা উপকারিতা থাকে তবে দেখতে হবে এ কথার চেয়ে আরো লাভজনক কোনো কথা আছে কি না? যদি থেকে থাকে তাহলে তাই বলবে। অন্য কোনো কথা নয়।তবেই মুখ ও মুখের কথার দ্বারা জেনা-ব্যভিচারসহ যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব হবে। জেনা-ব্যভিচার প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
মনে রাখা জরুরি
জেনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অপরাধ ও যাবতীয় অনিষ্টতা থেকে বেঁচে থাকতে মুখ ও কথার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকা জরুরি। কথার দ্বারা যে দুনিয়া ও পরকালে ক্ষতি হয় এ সম্পর্কে হাদিস থেকে সুস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়-
১. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘সে সত্তার কসম; যাঁর হাতে আমার জীবন! লোকটি এমন কথাই বলেছে, যা তার দুনিয়া ও পরকালের সবই ধ্বংস করে দিয়েছে।’ (আবু দাউদ)
২. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে, নিশ্চয়ই বান্দার পরিণাম চিন্তা ব্যতিরেকেই এমন কথা বলে যে কথার কারণে সে ঢুকে যাবে জাহান্নামের এমন গভীরে। যার দূরত্ব পূর্ব (পশ্চিম) এর দূরত্বের চেয়েও বেশি।’ (বুখারি, মুসলিম)
৩. হজরত বিলাল ইবনুল হারিস আল-মুজিানি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি কখনো আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির কথা বলে; যার সম্পর্কে সে ধারণাও করে না যে, তা কোথায় গিয়ে পৌছবে, অথচ আল্লাহ তাআলা তার এ কথার কারণে তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিন পর্যন্ত তার জন্য স্বীয় সন্তুষ্টি লিখে দেন।
আবার তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি কখনো আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টির কথা বলে, যার সম্পর্কে সে চিন্তাও করে না যে, তা কোন পর্যন্ত গিয়ে পৌছবে। অথচ এ কথার কারণে আল্লাহ তাআলা তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার দিন পর্যন্ত তার জন্য অসন্তুষ্টি লিখে দেন।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, মুসতাদরাকে হাকেম, ইবনে হিব্বান, মুয়াত্তা মালেক)
সুতরাং মানুষের উচিত, জেনা-ব্যভিচারসহ যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ থেকে মুক্ত থাকতে হাদিসের অনুসরণ ও অনুকরণ করা। আর তাহলো এমন-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ.
‘যার আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস রয়েছে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারি, মুসলিম, ইবনে মাজাহ)
মুখ ও কথা অনিষ্টতা থেকে নিজে বিরত থাকার পাশাপাশি নিজের পরিবার পরিজনকেও বিরত রাখার চেষ্টা করা। বিশেষ করে কোরআনের এ নির্দেশনা বেশি বেশি স্মরণ করে ভালো কথা বলার দিকে ধাবিত হওয়া জরুরি। তাহলো-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ وَ اَهۡلِیۡکُمۡ نَارًا وَّ قُوۡدُهَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ عَلَیۡهَا مَلٰٓئِکَۃٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا یَعۡصُوۡنَ اللّٰهَ مَاۤ اَمَرَهُمۡ وَ یَفۡعَلُوۡنَ مَا یُؤۡمَرُوۡنَ
‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে (জাহান্নামের) আগুন থেকে রক্ষা কর যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। যেখানে নিয়োজিত আছে নির্মম-হৃদয়, কঠোর-স্বভাব ফেরেশতাগণ; যারা আল্লাহ যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয়, তাই করে।’ (সুরা তাহরিম : আয়াত ৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মুখ ও মুখের কথায় খারাপ চিন্তা-চেতনা ও ফেতনা থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। ভালো কথা বলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।