নজরদারিতে অর্ধশতাধিক নারী নেত্রী, একাউন্ট তল্লাশি
একজন পাপিয়ার অবৈধ অর্থ-বিত্ত-প্রতিপত্তি, বিলাসী জীবনযাপন আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনগুলো নারী নেত্রীরা এথন প্রশ্নের মুখোমুখি। অনেকেই মনে করছেন, ক্ষমতার ছায়াবৃক্ষে আরও অনেক পাপিয়া আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে ফায়দা লুটছে। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের নির্দেশনায় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা অনৈতিক সুবিধা নেওয়া নারীনেত্রীদের চিহ্নিত করতে তৎপর। অর্ধশতাধিক নারী নেত্রীকে রাথা হয়েছে বিশেষ নজরদারিতে।
নজরবন্দি নারীনেত্রীদের তালিকায় রয়েছেন যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষপর্যায়ের বেশ কয়েকজন।যারা দীর্ঘদিন করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সচিবালয় কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতরে। তদবির বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি আর স্ফীতাকার ব্যাংক ব্যালান্স। রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে এবং ঘনঘন বিদেশ যাওয়া-আসাও ছিল এসব নারীর। ইতিমধ্যে কারও কারও ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের গ্রামের বাড়িতেও খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। সরকার ও আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২২ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা, ইয়াবা, মদ ও জাল মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। পরদিন তাকে নিয়ে নরসিংদী ও ঢাকার ফার্মগেটের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে ফার্মগেটের বাসা থেকে নগদ ৫৮ লাখ টাকা, অবৈধ পিস্তল ও গুলি, বিদেশি মুদ্রা ও মদ উদ্ধার করা হয়। এরপর সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দলীয় কিংবা যে পরিচয় থাকুক অপরাধে যুক্ত হলে অবশ্যেই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সরকারের সায় রয়েছে বলেই অপরাধীদের ধরা হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। সে যে দলেরই হোক।
পাপিয়ার ঘটনা প্রকাশের পর উদ্বিগ্ন এখন শাসক দলের শীর্ষনেতারা।আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, সম্রাট আর পাপিয়াদের মতো দুর্নীতিবাজ দুর্বৃত্তদের কারণে আমাদের সব অর্জন মুছে যাচ্ছে। এদের জন্য নিজেকে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। তিনি বলেন, সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশ আজ আলোকিত।কিন্ত দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর কেন এই দেশে সম্রাট ও পাপিয়ার মতো দুর্নীতিবাজদের জন্ম হবে। তাদের কারণে আজ আমাদের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক নীতি-নৈতিকতার চর্চা না থাকায় দলগুলোয় এমন অনেক পাপিয়া ঘাপটি মেরে রয়েছেন। কিছু নেতা-নেত্রীর ছত্রচ্ছায়ায় তারা সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সচিবালয়ে মন্ত্রী ও সচিবদের রুমে দেখা মেলে অনেক নেত্রীর। এর মধ্যে উঠতি ও মধ্য বয়সী নেত্রীদের একচেটিয়া দাপট। আওয়ামী লীগ যখন ‘বিরোধী দল’ ছিল তখন এদের অনেকেই দলের কোথাও ছিলেন না। গত ১১ বছর দল একটানা ক্ষমতায় থাকায় প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীদের তদবিরে কেন্দ্রে কিংবা জেলা পর্যায়ে পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছেন। ক্ষমতার দাপটে অথবা নানা ছলাকলায় হাতিয়ে কাজ বাগিয়ে নিয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছেন কেউ কেউ। অথচ ২০০১ সালের পর দলের দুঃসময়ে পুলিশের বেদম পিটুনি খাওয়া বিবস্ত্র আয়শারা বিনা চিকিৎসায় নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় ভাড়া বাসায় কাতরাচ্ছেন। আর পাপিয়ারা নিজেদের রূপ-জৌলসের উত্তাপ ছড়িয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, পাপিয়াকে গ্রেফতার করার পরই কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের নেত্রীদের চালচলনের বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের আলোচনায় আসে। কোন নেত্রী কোথায় কী করছেন, কে কাকে কোথায় পাঠাচ্ছেন, কাজ বাগিয়ে আনতে কে বেশি সচিবালয়ে যাচ্ছেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাপিয়াকে গ্রেফতারের পর যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে সংগঠনের শুদ্ধি অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার কাছে অনেক রিপোর্ট আসছে, অনেকের নাম আছে। আমি কাউকে ছাড়ব না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
সূত্র মতে, পাপিয়াকান্ডের পর যুুব মহিলা লীগের কয়েকজন নেত্রী ও উঠতি নেত্রী বিশেষ করে যারা কিছুদিন আগেও ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেত্রী ছিলেন তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেত্রীর ব্যাপারেও চাঞ্চল্যকর তথ্য পেতে শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। জানা যায়, রাজধানীতে নারী শিক্ষার ঐতিহ্যবাহী একটি প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে এক ডজন নারী নেত্রীর গতিবিধি নজরদারিতে এনে হঠাৎ বিত্তশালী হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর যাদের মেস ভাড়ার টাকার সংকট ছিল তারা এখন কেউ কেউ কোটি টাকার মালিক। হল বাণিজ্য, বড় ভাইদের কাছে ‘সাপ্লাই’ এবং বিভিন্ন মন্ত্রী ও নেতার কাছে তদবির বাণিজ্য করে টাকার মালিক হয়েছেন। কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতে ছনের ঘরের জায়গায় দোতলা/চারতলা বাড়িও করেছেন মাত্র কয়েক বছরেই। এদের অনেকের সঙ্গেই পাপিয়ার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, পাপিয়া গ্রেফতারের পর রাজনৈতিক পদ-পদবি ব্যবহার করে এমন কতজন নারী রাতারাতি শূন্য থেকে কোটিপতি হয়েছেন- তার খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, অর্ধশত নারী নেত্রীকে বিশেষ নজরে রাখা হচ্ছে। ব্যাংক হিসাবসহ গ্রামের বাড়িতেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেত্রীর ব্যাপারে কড়া নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তারকা হোটেলগুলোতেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
শাসকদলের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, পাপিয়াকাণ্ড প্রকাশের পর বিব্রত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। দলীয় অপকর্মকারীদের তালিকা করার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি দলীয়ভাবেও খোঁজখবর নিতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, পাপিয়াকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী চরম বিরক্ত। শুধু পাপিয়া নয়, আরও কত পাপিয়া আছে সেগুলো খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে এদের কারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন তাও খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যত বড়ই প্রভাবশালীই হোক জড়িতরা কেউ রেহাই পাবেন না। করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে তাদের।
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।