তুলনা হওয়ার কথা নয়। কারণ, বাংলার মেট্রোরেলের ইতিহাস ৩৮ বছরের পুরনো। বাংলাদেশের মেট্রো তার কাছে ‘সদ্যোজাত’ দুধের শিশু। তবে ঢাকা মেট্রো বুঝিয়ে দিয়েছে অভিজ্ঞতা না থাক, আধুনিকতায় পিছিয়ে নেই তারা।
বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সূচনা করেছেন ঢাকা মেট্রোরেল পরিষেবার। ট্রেনটি আপাতত পরীক্ষামূলক ভাবে সীমিত কয়েকটি স্টেশনে অল্প সময়ের জন্য চললেও মাস কয়েকের মধ্যে নিয়মিত পরিষেবা শুরু হবে।
তবে সেই পরিষেবা চালু হওয়ার আগেই পদ্মাপারের ঢাকা মেট্রো বেশ কয়েকটি বিষয়ে টেক্কা দিয়েছে গঙ্গাপারের কলকাতা মেট্রোকে।
শুরুতেই হাসিনার বাংলাদেশ গৎ ভেঙেছে মেট্রো চালানোর দায়িত্ব এক মহিলা চালককে দিয়ে। ঢাকা মেট্রোরেলের সূচনা সফরের প্রথম মেট্রোটিই চালিয়েছেন এক মহিলা চালক। তাঁর নাম মরিয়ম আফিজা।
তবে তিনি ছাড়াও বাংলাদেশের মেট্রো চালানোর দায়িত্বে থাকছেন আরও ৬ জন মহিলা চালক। যেখানে কলকাতা মেট্রোয় এখনও পর্যন্ত একজনও মহিলা চালক নেই।
কলকাতা মেট্রোকে ভাড়াতেও টক্কর দিয়েছে ঢাকা মেট্রো। কলকাতা মেট্রোয় যেখানে ন্যূনতম ভাড়া ৫ টাকা। সেখানে ঢাকা মেট্রোয় প্রতি কিলোমিটার পিছু ভাড়া নেওয়া হবে ৫ টাকা করে।
সেক্ষেত্রে শুধু একটি স্টেশন যেতেই ভাড়া লাগবে ন্যুনতম ২০ টাকা। অর্থাৎ কলকাতা মেট্রোর ৪ গুণ। আবার ঢাকা মেট্রোর প্রথম থেকে শেষ স্টেশন পর্যন্ত যেতে ভাড়া দিতে হবে ১০০ টাকা। যেখানে কলকাতা মেট্রোর একটি রুটের সর্বোচ্চ ভাড়া ২৫ টাকা। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ভাড়াও ৪ গুণ।
সব মিলিয়ে ১৭টি স্টেশন রয়েছে বাংলাদেশ মেট্রোয়। কলকাতায় সেখানে মূল মেট্রো রেলপথে অর্থাৎ কবি সুভাষ থেকে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত রয়েছে ২৬টি স্টেশন।
ঢাকা মেট্রো রেলপথের দূরত্বও কলকাতা মেট্রোর ব্লু লাইন রুট (কবি সুভাষ থেকে দক্ষিণেশ্বর)-এর থেকে কম। ব্লু লাইন ৩১.৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। ঢাকা মেট্রো পথের দূরত্ব ২১.২৬ কিলোমিটার।
তার পরও ভাড়া এত বেশি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ঢাকার মন্ত্রী জানিয়েছেন, কলকাতার মেট্রোর সঙ্গে ঢাকা মেট্রোর তুলনা করা ঠিক হবে না। কারণ ঢাকা মেট্রোর পরিকাঠামো অনেক আধুনিক। তাই খরচও বেশি।
কী কী আধুনিক পরিষেবা রয়েছে ঢাকা মেট্রোয়? বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, ১৭টি স্টেশনের ২১.২৬ কিলোমিটার পথ ৩৮ মিনিটে অতিক্রম করবে ঢাকা মেট্রো। প্রতি সাড়ে ৩ মিনিট অন্তর ট্রেন এসে দাঁড়াবে স্টেশনে।
ঢাকার মেট্রোর স্টেশন থাকবে তিনতলায়। একতলায় স্টেশন প্লাজা, দোতলায় টিকিট কাউন্টার, মেট্রোর অফিস এবং নানা যাত্রী সুবিধার ব্যবস্থা সম্পন্ন কনকোর্স হল। তৃতীয় তলে শুধু টিকিট কেটেই ওঠা যাবে। সেখানে রেল লাইন এবং প্ল্যাটফর্ম।
ঢাকা মেট্রোয় টিকিট কাটতে কাউন্টারের কর্মীর উপর নির্ভর করতে হবে না। স্বয়ংক্রিয় টিকিট সংগ্রহের মেশিন বসানো থাকবে প্রতি মেট্রো স্টেশনের দোতলায়। সেখানে যাত্রীরা নিজেরাই টিকিট কেটে নিতে পারবেন।
স্মার্ট কার্ডেরও ব্যাবস্থা থাকবে। মেট্রো রেলে যাতায়াতের জন্য এক সপ্তাহের, এক মাসের মেয়াদের কার্ড করাতে পারবেন যাত্রীরা। আবার পারিবারিক কার্ডেরও সুবিধা থাকবে। নির্ঝঞ্ঝাট যাতায়াতের জন্য র্যাপিড পাসেরও ব্যবস্থা থাকবে মেট্রোর যাত্রীদের জন্য।
বিশেষ ভাবে সক্ষম যাঁরা, তাঁদের জন্য থাকবে টিকিট কাটা, টিকিট জমা দেওয়া এবং প্ল্যাটফর্মে ঢোকা-বেরনোর আলাদা ব্যবস্থা। হুইলচেয়ারের কথা মাথায় রেখে টিকিট বুথ গুলিকে নীচু করা হয়ছে। আলাদা প্রবেশ পথও প্রশস্ত করা হয়েছে তাঁদের কথা ভেবে।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের জন্য লিফটেও থাকবে বিশেষ সুবিধা, ধরার হাতল, নীচু কন্ট্রোল প্যানেল, ব্রেইলের নির্দেশিকা। এ ছাড়া দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্লাইন্ডস্টিক, মূক বধিরদের জন্য ডিজিটাল নির্দেশিকা, হলুদ রঙে আলাদা করে দেওয়া নির্দিষ্ট পথ। আলাদা লিফট্ এমনকি আলাদা আসনেরও ব্যবস্থা থাকবে।
মহিলা যাত্রীদের জন্যও বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা থাকছে ঢাকা মেট্রোস্টেশনে। দোতলার কনকোর্স হলে তাঁদের জন্য থাকবে আলাদা শৌচাগার, বিশ্রামঘর, এমনকি সদ্যোজাতদের নিয়ে যাতায়াতকারী মায়েদের সুবিধার জন্য ডায়াপার পরিবর্তনের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে কনকোর্স হল সংলগ্ন এলাকায়।
মেট্রোরেলের ভিতরেও অন্তঃসত্ত্বা এবং বয়স্ক যাত্রীদের জন্য আসন সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
আপাতত ৪টি স্টেশনে থাকছে স্টেশন প্লাজার ব্যবস্থা। যেখানে গাড়ি নিয়ে সরাসরি মেট্রো রেলের লিফটের কাছে চলে আসতে পারবেন যাত্রীরা। এ খানে গাড়ি পার্কিংয়েরও ব্যবস্থা থাকবে। ব্যক্তিগত গাড়ি তো বটেই বাস, ট্যাক্সি, অটো কিংবা রিকশাও আসতে পারবে এই চত্বরে। আবার এই এলাকাতেই থাকবে মেট্রোযাত্রীদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও
উত্তরা (নর্থ) বা দিয়াবাড়ি স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে কমলাপুর পর্যন্ত চলবে ঢাকা মেট্রোরেল। এর মধ্যে স্টেশন প্লাজা থাকছে দিয়াবাড়ি, আগারগাঁও, ফার্মগেট এবং কমলাপুর স্টেশনে।
এ ছাড়া প্ল্যাটফর্মে অর্থাৎ স্টেশনের তিন তলায় থাকবে বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টনীও। দুর্ঘটনা এড়াতে ‘প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর’–এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই দরজা স্টেশনে ট্রেন থামার পর ট্রেনের দরজার সঙ্গে খুলবে আবার নির্দিষ্ট সময় পর স্বয়ংক্রিয় ভাবেই বন্ধ হবে।
আরও আছে। মেট্রোরেলের স্টেশনের সিঁড়ি, লিফট্ বা এসকেলেটর ব্যবহার করে কনকোর্স হল ব্যবহার করে ট্রাফিক এড়িয়ে রাস্তার পারাপার করতে পারবেন যাত্রীরা। প্রতিটি মেট্রোস্টেশনকে নিরাপদ ফুট ওভারব্রিজ হিসাবেও ব্যবহার করা যাবে।
ট্রেন যাতে কোনও ভাবেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাত্রী দুর্ভোগের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য অন্তত ৫টি বিদ্যুতের বিকল্প লাইনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে ঢাকা মেট্রো। যাতে একটি বা ২টি কোনও ভাবে সমস্যায় পড়লেও বাকিগুলি কাজ করে।
এ ছাড়া ট্রেনের নিরাপত্তার জন্য থাকছে অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশনের ব্যবস্থাও। আপৎকালীন সময়ে ট্রেন থেকে বের হওয়ার জন্য জরুরি দরজা রাখা হয়েছে। মেট্রো স্টেশন, রুট অ্যালাইনমেন্ট এবং ট্রেনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা হিসেবে স্বয়ংক্রিয় স্প্রিঙ্কলার ও ওয়াটার হাইড্রান্ট সংযোজনের ব্যবস্থাও থাকছে।
আপাতত প্রতি ট্রেনে ৬টি করে কোচ থাকবে এবং ট্রেন পিছু ২৩০৮ জন করে যাত্রী যেতে পারবেন। ট্রেন চলবে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে।
আপাতত উত্তরা (উত্তর) থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কোনও বিরতি ছাড়া ট্রেন চলবে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। মার্চ-এপ্রিল থেকে এই পথে প্রতি স্টেশনে থামবে ট্রেন। পরিষেবার সময়ও বাড়বে রাত পর্যন্ত। তবে পুরোপুরি ১৭টি স্টেশনে নিয়মিত পরিষেবা শুরু হতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সূত্র: আনন্দবাজার
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।