মা হারা শিশু সন্তানদের ঘরে তালাবদ্ধ করে উপার্জনে ছুটেন অসহায় পিতা

নিজস্ব প্রতিবেদক
এইচ.এম.এ রাতুল, জেলা প্রতিনিধি, বরিশাল।
প্রকাশিত: বুধবার ১২ই জুলাই ২০২৩ ০৫:৩৪ অপরাহ্ন
মা হারা শিশু সন্তানদের ঘরে তালাবদ্ধ করে উপার্জনে ছুটেন অসহায় পিতা

রনি শিকদার ওরফে ফিরোজ। বয়স ৩৩ বছর। মা হারা দুই শিশু সন্তান ২৩ মাসের নূর আর সাড়ে ৩ বছরের মরিয়মকে ঘরে তালাবদ্ধ করে উপার্জনের জন্য রিক্সা নিয়ে রাস্তায় ছুটেন তিনি। শিশু সন্তানদের তালাবদ্ধ ঘরে একা একা রেখে বাহিরে বের হয়ে অজানা আতংকে থাকেন ফিরোজ। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে এভাবেই কাটছে ফিরোজের সংসার। এমন অসহায়ত্বের জীবন যাপনের বিষয়টি নজরে আসে এ প্রতিনিধির। 


তার সাথে কথা হলে ফিরোজ জানান, ২০১৫ সালে বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া থানার বারপাইক্কা গ্রামের বাসিন্দা এনায়েত শাহ’র মেয়ে মারজানকে বিয়ে করেন তিনি। সুখে শান্তিতেই কাটছিল তার সংসার। এরই মধ্যে তাদের কোল জুড়ে আসে দুই সন্তান মরিয়ম ও নূর। কিন্তু হঠাৎই তার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ৫ মাস বয়সী ছেলে নূর এবং দেড় বছর বয়সী কন্যা মরিয়মকে রেখে বাবার বাড়িতে বসে আত্মহত্যা করেন স্ত্রী মারজান। 


ফিরোজ জানান, স্ত্রী মারজান আত্মহত্যার তিন দিন পূর্বে ২৭ ডিসেম্বর তিনি শ^শুর বাড়ি আগৈলঝাড়ায় বেড়িয়ে আসেন। তখনও বুঝতে পারেননি তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাবেন না ফেরার দেশে। ঘটনার দিন ৩০ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে (শ^শুর বাড়িতে কারো ফোন না থাকায় ফিরোজ তার সন্তানদের খোঁজ খবর নিতে শ^শুরে পাশর্^বতী বাড়িতে ফোন দেন। ওপাশ থেকে শাশুড়িকে ডাকলেও তিনি কথা বলতে রাজী হননি। ওই দিনই ভোর রাত ৪টার দিকে শাশুরি ফোন করে ফিরোজকে জানায় তার সন্তানরা অসুস্থ এখই তাকে আসতে হবে। এমন সংবাদে ওই রাতেই ট্রাকে করে আগৈলঝাড়ায় পৌঁছান ফিরোজ। গিয়ে দেখেন তার স্ত্রী মরদেহ ঝুলে আছে। আচমকা এমন দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে যান ফিরোজ। এ সময় তাকে ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে তার শ্যালক আব্দুল্লাহসহ একাধিক লোকজন তাকে মারধর করে আগৈলঝাড়া পুলিশের হস্তান্তর করে। অপরাধ হিসেবে অভিযোগ করা হয় তার (ফিরোজের) সাথে শ্যালিকা আমেনার পরকীয়া সম্পর্কের কারণেই মারজান আত্মহত্যা করেছে। তবে ফিরোজের ভাষ্য, তিনি জানতে পেরেছেন তার স্ত্রীর সাথে শ্যালিকা আমেনার ঝগড়ার জের ধরে মারজান আত্মহত্যা করেছে। 


ফিরোজ জানান, পুলিশ তাকে আদালতে প্রেরণ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। দীর্ঘ সাড়ে ৪ মাস কারাভোগের পর জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট কারাগার পরিদর্শনে গেলে তাকে দুটি গান শোনান ফিরোজ। এসময় ম্যাজিষ্ট্রেট তার সাথে একান্তে কথা বললে ঘটনা খুলে বলেন ফিরোজ। পরে বিজ্ঞ আদালত তাকে মামলা থেকে খালাস দিয়ে দেন। 


এ ঘটনার কিছুদিন পর ঈদ এলে সন্তানদের দেখতে পুনরায় আগৈলঝাড়ায় যান ফিরোজ। সেখানে গেলে তার শ^শুর এনায়েত শাহ, শাশুড়ী ও শ্যালক আব্দুল্লাহসহ একাধিক ব্যাক্তি তাকে বেধরক মারধর করে সন্ধ্যার পর রাস্তায় ফেলে রেখে দেয়। তাদের মারধরে ফিরোজের চোখে রক্তক্ষরণ হলে সে কিছুই দেখতে পায়নি। রাতে একজন ভ্যান চালক তাকে রাস্তা থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে বরিশালের ভাড়া বাসার পাশর্^বর্তী বাসিন্দাদের সহযোগিতায় আগৈলঝাড়া থেকে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেলে নিয়ে আসে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফিরোজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় শাশুড়ী, শ্বশুর ও দুই শ্যালককে আসামী করা হয়। 


এ ঘটনার পর শ^শুর বাড়ির লোকজন ফিরোজকে জানায়, তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিলে তার শিশু সন্তানদের দেখাশোনা করবেন তারা। অসহায় ফিরোজ তাদের কথা মতো মামলা তুলে নেয়ার ৪ দিনের মাথায় তার সন্তানদের ফিরোজের কাছে ফেলে রেখে যায়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দুই শিশু সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন ফিরোজ। সকাল হলেই সন্তানদের জন্য রান্না করে খাইয়ে ঘরে তালা মেরে উপার্জনের জন্য ছুটেন তিনি। দুপুরে বাসায় ফিরে সন্তানদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে বিকেল হলে সন্তানদের নিয়েই উপার্জনের জন্য বের হন। কিন্তু সন্তান দুটি রিক্সায় থাকায় যাত্রী উঠতে রাজী হন না। এছাড়া সন্তানরা মলমূত্র ত্যাগ করে ঘর নোংরা করায় বাড়িওয়ালাও তাকে ঘর ছেড়ে দিতে তাগিদ দিচ্ছেন। 


ফিরোজ বলেন, অবুঝ দুই সন্তানকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রেখে বাহিরে বের হলেও অজানা আতংকে থাকেন তিনি। ফিরোজের প্রশ্ন তাদের সন্তানদের যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তিনি কোথায় যাবেন? আর এ দায় তিনি কার উপর দিবেন? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তার মা-বাবা নেই। এক ভাই আছেন যিনি ঢাকায় থাকেন। তার কাছে অনুরোধ করেছিলেন সন্তানদের নেয়ার জন্য। কিন্তু তারা রাজী হননি।


ফিরোজ বলেন, সমাজের কোন বিত্তশালী ব্যাক্তি তাকে কোন আর্থিক সহায়তা করতেন তবে ভাড়া বাসার সামনেই ছোটখাটো ব্যবসা করার পাশাপাশি সন্তানদের দেখভাল করতে পারতেন।


ফিরোজের প্রতিবেশী ও রিক্সা মহাজন নগরীর ১নং ওয়ার্ডের পশ্চিম কাউনিয়া হাজেরা খাতুন স্কুল এলাকার বাসিন্দা মো. সুলতান হাওলাদার বলেন, তিনি সহ প্রতিবেশী অনেকেই তালাবদ্ধ ঘরের জানালা দিয়ে শিশুদের দেখাশোনা করেন। আর মাঝে মধ্যে তিনি তালা খুলে সন্তানদের খোঁজখবর রাখেন।