বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা নিয়ে প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটির আফ্রিকা বিষয়ক সম্পাদক ডেভিড পিলিং এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে নানা বাধার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অভিযাত্রা নিয়ে কথা বলেছেন। পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কোন কোন নির্ণায়কে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে, বিভিন্ন অর্থনীতিবিদের বরাত দিয়ে তা তুলে ধরেছেন তিনি।
তিনি ১৯৯০ সালের বাংলাদেশ নিয়ে লিখেন, সেসময় দেশটির মাথাপিছু আয় ৫০০ ডলারেরও কম, কিন্তু নারীদের গড়ে ৪ দশমিক ৫টি সন্তান এবং দেশটির ৪৪ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ছিল।
এরপর বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেন, আজ এই দেশের সেসব সমস্যার সমাধান হয়েছে। জিডিপি বেড়ে আট গুণ হয়েছে। দেশটির নারীরা গড়ে দুটি সন্তান নিচ্ছেন। এর মানে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধির জন্য আরও বেশি অর্থ পাচ্ছেন। সেই সঙ্গে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্নির্মাণে ব্যাংকগুলোতে জমা অর্থের পরিমাণও বাড়ছে।
ডেভিড পিলিং লিখেছেন, বাংলাদেশে নারীদের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। শিক্ষায় মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের তুলনায় মেয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, তখন প্রতি ৫ শিশুর একজন ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যেত। এখন সেই সংখ্যা প্রতি ৩০ জনে একজন।
তিনি লিখেন, সত্যি যে, এখনো দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিবেশগত হুমকি এবং উচ্চ মাত্রায় দুর্নীতি রয়েছে। চলতি সপ্তাহেই দেশটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ঋণ চেয়েছে। তবে আরও বড় পরিসরে ভাবলে বোঝা যায় হেনরি কিসিঞ্জারের একসময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে সমালোচিত দেশটি এখন উন্নয়নে সফল।
ডেভিড পিলিং লিখেছেন, বাংলাদেশ যা কিছু সত্যিকার অর্থে সম্ভব তার একটা চিত্র তুলে ধরেছে এবং যারা দেশটির জন্মের পরের সময়কার মতোই এর ভবিষ্যৎ হবে ভেবেছিল এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছিল, তাদের সেসব দাবি ভুল প্রমাণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া স্বাধীন বাংলাদেশ দ্রুতই দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়। এমন বাজে শুরুর পর দেশটি এখন উন্নয়নের সারথি।
এর পর তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নবিষয়ক অর্থনীতিবিদ স্টেফান ডেরকনের বরাত দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমেই আছে এ দেশের পোশাকশিল্প, যা আকার ১৯৮৪ সালে ছিল ৩২ মিলিয়ন আর এখন তা ৩৪ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের বৈদেশিক আয় বেড়েছে। বাংলাদেশিরা বিভিন্ন দেশ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ পাঠিয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা যেমন: ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সৃষ্টি করছে এবং গরিবদের স্বাবলম্বী করে তুলছে।
ডেভিড পিলিং এ প্রসঙ্গে আরও লিখেছেন, সত্যি, বাংলাদেশ তার সস্তা শ্রমবাজারের ব্যবহার করেই নিজেকে গড়ে তুলেছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে সহস্রাধিক পোশাকশ্রমিক মর্মান্তিকভাবে মারা যান। যদিও বেশির ভাগ শিল্পোন্নত দেশেরই এমন নেতিবাচক ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। যুক্তরাজ্যে উনিশ শতকে ভিক্টোরিয়ান বস্তিতে সংক্রমণ, জাপানে মিনামাতা পারদ বিষাক্তকরণ কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা রয়েছে।
এখানেই থামেননি ডেভিড পিলিং। এরপর তিনি বাংলাদেশ নিয়ে রেনেসাঁ ক্যাপিটালের প্রধান অর্থনীতিবিদ চার্লি রবার্টসনের কথাও উল্লেখ করেন। এই অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের উন্নয়নকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন- শিক্ষার হার, বিদ্যুৎ ও উর্বরতা। তার গ্রন্থ ‘টাইম ট্রাভেলিং ইকোনমিস্টে’ তিনি ৭০ শতাংশের বেশি শিক্ষার হার, ৩০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ এবং তিনটি সন্তানের কম নেয়ার বিষয়টিকে বাংলাদেশের শিল্পোন্ননের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রবার্টসন মনে করেন, কোনো দেশ তার উর্বরতার হার ৩ শতাংশের কম না হলে অর্থনৈতিক মুক্তি পেতে পারে না। তবে এখানে একটি আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে, পরিবারের আকার ছোট হলে এর সঞ্চয়ের সুযোগ বাড়ে এবং ব্যাংকেরও শিল্পঋণ দেয়ার সক্ষমতা বাড়ে। বাংলাদেশের জিডিপিতে ঋণের পরিমাণ ৩৯ শতাংশ, যেখানে নাইজেরিয়ায় ১২ শতাংশ। নাইজেরিয়ার উর্বরতার হার ৫ দশমিক ২ এবং বাংলাদেশের ২ শতাংশ।
ডেভিড পিলিং তার বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে আরও লিখেছেন, বাংলাদেশ এখন যে অবস্থানে আছে, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৭৫ সালে ছিল। বাংলাদেশ এটা দেখিয়েছে যে কর্দমাক্ত কঠিন পথ দিয়েও উন্নয়নের পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।