ইট ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পুড়লো কৃষকের স্বপ্ন !

নিজস্ব প্রতিবেদক
শফিউল আলম রাজীব, উপজেলা প্রতিনিধি - দেবীদ্বার, কুমিল্লা
প্রকাশিত: সোমবার ২২শে এপ্রিল ২০২৪ ০৮:১৯ অপরাহ্ন
ইট ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পুড়লো কৃষকের স্বপ্ন !

কুমিল্লার দেবীদ্বারে ইট ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় শতাধিক একর আবাদী জমির ফসলের ক্ষতিসাধন হয়েছে । তার সাথে শতাধিক কৃষকের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন পুড়ে ছাঁই হয়েছে। এদিকে ফসলের ক্ষতিপুরনের দাবীতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা ইটভাটা ঘেড়াও করে কর্মকর্তাদের ১৫ ঘন্টা অবরোধ করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।


ঘটনাটি ঘটে, শনিবার (২০এপ্রিল) ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের ‘চন্দ্রনগর- বারুর’ গ্রামে অবস্থিত ‘ব্রাদার্স ব্রীকস ফিল্ডে’। ওই ব্রীক্স ফিল্ডের ব্যবস্থাপকসহ কয়েকজন কর্মচারীকে বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা প্রায় ১৫ ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখে । পরে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপে দ্রুত ক্ষতিপুরণ পরিশোধের আশ্বাসে শনিবার রাত ৯টায় অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়।


সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থলে সরজমিনে গিয়ে কৃষকদের সাথে কথা বলার সময় তাদের আহাজারী, আর্তনাদ, অভিযোগে আকাশ ভারী হয়ে উঠে। আগামী দিনগুলোতে পরিবার পরিজনকে নিয়ে কি খেয়ে বাঁচবে সেই আক্ষেপই অধিকাংশ কৃষকের।


স্থানীয়রা জানান, গত শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) রাতে ব্রাদার্স ব্রীক্স ফিল্ডের চিমনির বিষাক্ত ধোঁয়ায় কয়েক মিনিটের বাতাসের চাঁপে প্রায় একশত একর ফসলী জমির বোরোধান জ্বলে শেষ হয়ে যায়। ওই ঘটনায় পরিদর্শনের আসা কৃষি কর্মকর্তা আমাদের বলেছেন এ ফসলের পরিচর্যা করে আর লাভ হবেনা। তাই আমরা ফসলের ক্ষতিপুরণ চেয়ে মালিক পক্ষের নিকট আবেদন করেছি। তারা আরো জানান, ব্রীকস ফিল্ডটি সম্পূর্ণ অবৈধ। রাজনৈতিক প্রভাবে ঘনবসতীপূর্ণ এলাকা ও কৃষি জমিতে এক কিলোমিটারের মধ্যে ১টি আধুনিক ব্রীকস ফিল্ডসহ ১১টি ব্রীক্স ফিল্ড তৈরী করা হয়েছে। ফলে এসব ব্রীক্স ফিল্ডের বিষাক্ত ধোঁয়ায় আম- কাঠাল-নারিকেলসহ ফল ফলাদী, মাছ, পাখী এবং ফসলী জমির উপর বিপর্যয় ঘটে। ব্রীক্স ফিল্ডগুলোর মাটি বহনকারী ট্রাক্টরের চাকায় সড়কগুলো যেমন খানাখন্দ হয়ে থাকে তেমনি ধূলাবালিতে বাড়িঘর ঢেকে যায়। বালুবাহী শ্বাসকষ্ট জনিত রোগবালাইসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু বয়স্করা।


সংবাদ পেয়ে দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিগার সুলতানা শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং ব্রীক্স ফিল্ডের মালিককে ৩দিনের মধ্যে কৃষকের ফসলের ক্ষতিপুরণ প্রদানের নির্দেশ দেন, অন্যথায় ইউএনও নিজে বাদী হয়ে ব্রীকস ফিল্ড মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবেন বলে হুশিয়ার করেন।


ষাটোর্ধ বয়সী কৃষক মো. সফিকুল ইসলাম কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার ১৫ শতাংশ জমিতে ১৭/১৮ মন ধান পেতাম। এখন সবই শেষ, সামনের দিনগুলোতে পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে বাঁচব সে চিন্তায় আছি।


কৃষক মনিরুজ্জামান জানান, আজ থেকে ১২ বছর পূর্বে ব্রাদার্স ব্রীক্স ফিল্ড নির্মানে বাঁধা প্রদান করায় মালিক পক্ষ, প্রশাসন ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর হাত থেকে জীবন বাঁচাতে আমি, মীর মনি, ধনু মিয়া, আব্দুল কাদের, আব্দুল আলিম ৬বছর পালিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেছি। পরে এ নিয়ে আর কোন প্রতিবাদ না করার শর্তে বাড়িতে ফিরি। আব্দুল কাদের আর ফিরে আসেনি, সে প্রবাসে চলে যায়, এখনো প্রবাসে আছে।


এ ব্যপারে ব্রাদার্স ব্রীক্স ফিল্ডের ব্যবস্থাপক আবুল খায়ের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আগুন মিস্ত্রি মহসীন মিয়া ফিল্ডে ইট পোড়াতে অতিরিক্ত কয়লা জ্বালাতে যেয়ে চিমনির ধোঁয়া বাতাসের চাঁপে ফসলের ব্যপক ক্ষতি সাধন হয়। আমরা কৃষকদের বাঁচাতে ক্ষতিপুরন দিতে প্রস্তুত আছি, ইতিমধ্যে ৩৩ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা প্রস্তুত করেছি। আগামী ১/২ দিনের মধ্যে বাকী তালিকা সম্পন্ন করব। কৃষি কর্মকর্তার ক্ষতি পুরনের হিসেবের তালিকা পেলেই আমরা পরিশোধ করে দেব।


তদন্ত কমিটির প্রধান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বানিন রায় জানান, ইউএনও’র নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটিতে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি মেম্বার, অভিযুক্ত ব্রীক্স ফিলের মালিক, ব্রীকস ফিল্ড সমিতির কর্মকর্তা, এলাকার গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ ও ক্ষতিগ্রস্থ্য কৃষকদের সমন্বয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রনয়নে জমির মালিক, জমির পরিমান, ক্ষতিগ্রস্থ্য ফসলের মূল্য নির্ধারণপূর্বক আগামী মঙ্গলবারের দিনের মধ্যে ক্ষতিপুরনের অর্থ পরিশোধের নির্দেশ দেন। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এখনো প্রকৃত ক্ষতির পরিমান ও জমির পরিমান নির্ধারন করা শেষ হয়নি।


দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিগার সুলতানা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এ ব্যপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বানিন রায়কে আহবায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল)’র মধ্যে বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব দিয়েছি। তাছাড়া অবৈধ ইট ভাটা বন্ধ ও জরিমানা আদায় অব্যাহত আছে।