ক্যাসিনো কাণ্ডের মতোই ঝড় তুলেছে পাপিয়ার অপরাধ জগতের গল্প। মুখে মুখে আলোচনা নরসিংদী থেকে উঠে আসা পাপিয়া কীভাবে এই সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন। কারাইবা মদত দিয়েছে তাকে। এই অপরাধ জগতের সুবিধাভোগী কারা এনিয়েও আলোচনা চারপাশে। র্যাবের হাতে পাকড়াও হওয়ার পর একের পর এক বেরিয়ে আসে পাপিয়ার অন্ধকার জগতের নানা তথ্য। খোঁজা হচ্ছে তার মদতদাতাদের। ইতোমধ্যে তিন মামলায় ১৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তাকে। জিজ্ঞাসাবাদে এ সংক্রান্ত আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

বিমানবন্দর থানার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্মক (তদন্ত) কাজী কায়কোবাদ পাপিয়াসহ মোট চারজনকে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাদেরকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমাণ্ড আবেদন করেন। রিমাণ্ড আবেদনে তিনি বলেন, পাপিয়াসহ চার আসামি সংঘবদ্ধভাবে অবৈধ অস্ত্র, মাদক, চোরাচালন ও জাল নোটের ব্যবসা, চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য, জমি দখল- বেদখল করে অনৈতিক ব্যবসা বাণিজ্যর মাধ্যমে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছে। মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার উৎস, জাল টাকা তৈরি চক্রের সক্রিয় সদস্যদের মূলহোতাকে গ্রেপ্তারসহ ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন।
এসময় আসামি পক্ষের আইনজীবির সওদাগর অ্যানী ও মশিউর রহমান রিমাণ্ডের বিরোধীতা করে জামিন আবেদন করেন। দুই পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদুর রহমান ও মোহাম্মদ জসীম তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর মধ্যে বিমানবন্দর থানার বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম মাসুদুর রহমান পাঁচ দিন, শেরেবাংলা নগর থানার অস্ত্র ও মাদক আইনে দায়ের করা মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসীম পাঁচ দিন করে মোট দশদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এর আগে বিকাল সাড়ে তিনটার দিকেপুলিশ পাপিয়াসহ চার আসামিকে আদালতে হাজির করে। আদালতের কাঠগড়ার পাশে একটি চেয়ারে তাকে বসানো হয়। পরে পাপিয়াকে দেখার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর উৎসুক জনতারা আদালত পাড়ায় ভীড় করেন। এসময় অনেকেই পাপিয়া ও তার সহযোগীদের ছবি তুলেন। র্যাব জানিয়েছে পাপিয়ার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে আরেকটি মামলা হবে। এ নিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে।
নরসিংদীতে তোলপাড়: পাপিয়া ও সুমনের নেপথ্যের কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর এই দম্পতির কথা এখন নরসিংদীতে ‘টক অব দ্য টাউন’। রোববার সকালে র্যাব-১ এর একটি তদন্তকারী টিম নরসিংদী শহরের ভাগদীস্থ পাপিয়ার পিত্রালয় ও পশ্চিম ব্রাহ্মন্দীস্থ শ্বশুরালয়ে অভিযান চালায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০০ সালের দিকে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমনের উত্থান শুরু। শৈশব থেকেই চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও ব্ল্যাকমেইল ছিল মফিজের প্রধান পেশা। সুমন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন।
২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিককে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পর মফিজ আলোচনায় আসেন। এরপর মফিজ পাপিয়াকে বিয়ে করে। এরপরই তার স্ত্রী পাপিয়াকে রাজনীতিতে যুক্ত করেন। প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের পর দুর্বৃত্তায়ন রোধকল্পে সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নরসিংদী-১ আসনের এমপি লে: কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু, নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং নরসিংদী পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল সন্ত্রাসী মফিজ ও তার স্ত্রী পাপিয়াকে আওয়ামী লীগের কর্মকান্ডে আসতে নিষেধ করেন। এর কয়েকমাস পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ভাঙন দেখা দিলে পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন একটি গ্রুপে যোগ দেয়। অপরদিকে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে ঢাকা সংরক্ষিত আসনের সাবেক মহিলা এমপি সাবিনা আক্তার তুহিনের সঙ্গে।
২০১৪ সালের ১৩ই ডিসেম্বর জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে বতর্মান জেলা পরিষদের সংরক্ষিত সদস্য তৌহিদা সরকার রুনা সভাপতি ও শামীমা নূর পাপিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এলাকায় অভিযোগ আছে, পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন নরসিংদী এলাকায় ‘কিউ অ্যান্ড স্থি নামের একটি ক্যাডার বাহিনী পরিচালনা করতেন। যাদের মাধ্যমে তারা নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, মাসোহারা আদায়, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন। তাদের এই ক্যাডার বাহিনীর অনেকের নাম ইতোমধ্যে জানা গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য র্যাবের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানা যায়।
গত কয়েক বছর আগে পাপিয়ার উপস্থিতে তার স্বামী সুমন তার প্রতিপক্ষের হামলায় নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় মফিজ। তার চিকিৎসার পর সে সুস্থ হলে এর পর থেকে সে নরসিংদী ছড়ে ঢাকায় পাড়ি জমায়। নরসিংদী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র কামরুজামান কামরুল বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামীর চলাফেরা ৯/১০ বছর আগ থেকে আমাদের সন্দেহ ছিল। তখন থেকেই তাদেরকে আমরা নরসিংদীতে এবং রাজনীতি থেকে বিদায় করে দিয়েছি।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন ভূইয়া বলেন, যুব মহিলা লীগের কোন অস্তিত্ব নেই। নরসিংদী আওয়ামী লীগের কোন নেতার সাথে আলোচনা বা পরামর্শ ছাড়াই এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বাধা দেয়ার পরও কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অপু উকিল পাপিয়াকে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক করেন।