শামীমের লেনদেন দেখে বিস্মিত তদন্ত সংস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক
সাখাওয়াত জামিল সৈকত (অতিথি লেখক)
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৩৯ অপরাহ্ন
শামীমের লেনদেন দেখে বিস্মিত তদন্ত সংস্থা

‘টেন্ডারবাজ’ খ্যাত ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের ব্যাংক হিসাব দেখে বিস্মিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। তার ৩৪টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। পুলিশ ও র‌্যাবের প্রাথমিক তদন্তে একই চিত্র উঠে এসেছে। এ ছাড়া পুলিশের এজাহারেও ব্যাংক হিসাবের তালিকা ও জমা এবং এফডিআর করা অর্থের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, জি কে শামীমের নগদের পাশাপাশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা প্রভাবশালীদের ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য রয়েছে। এমনকি তিনি বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। তার আত্মীয়-স্বজনের নামেও অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা জমিয়ে রাখার তথ্য পেয়েছেন তারা। এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, অর্থ পাচার মামলার বিশেষায়িত তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) হস্তান্তর করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সিআইডি তদন্ত শুরু করেছে। দেশের বাইরে কী পরিমাণ অর্থ পাচার করছেন, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ৩৪টি ব্যাংক হিসাবে জি কে শামীম কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে খোলা এসব হিসাবের বেশির ভাগই জি কে শামীম ও তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানির নামে। তা ছাড়া কয়েকটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে যৌথভাবে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। জি কে শামীমের নামে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মহাখালী শাখার হিসাব নম্বর ৪০৩৮১১১০০০০০৩৫৪, ৪০৩৮১২৪০০০০০০২৫, গুলশান লিংক রোডের ইসলামী ব্যাংকে হিসাব নম্বর ১৬৪১০২০০০০৮২৫, ১৬৪১২২০০০০০৮৫ ও ১৬৪১০২০০০১১৪১, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডের উত্তর শাহজাহানপুর শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বর ০০১১১০০১১৪৮৯২ ও ০০১২১০০০২১৮০১, ট্রাস্ট ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ শাখার ০০৩৫০২১০০০৩০৮৩, ০০৩৫০২১০০০৩০০১, ০০৩৫০২১০০০০৩০৮, ০০৩৫০১৩৬০০০০৩৯, ০০৩৫০২১০০০২৬৪৬, ট্রাস্ট ব্যাংক মহাখালী শাখার ০০৭৪০৩১৮০০০০০৬৩, ০০৭৪০২১০০০০২৫,  ট্রাস্ট ব্যাংক নারায়ণঞ্জ শাখার ০০৩৫০৩১৮০০১৪৭০, ০০৩৫০২১০০০৪৬৪৪, ০০৩৫০২১০০০৪০১৯,  ট্রাস্ট ব্যাংক কেরানীগঞ্জ শাখার ০০৬৫০২০০০২৯৩৫, ইউসিবি ব্যাংকের গুলশান শাখা ০৯৫৩১০১০০০০০১২৯৯,  যমুনা ব্যাংকের একটি শাখার ০০৯০২১০০০৮৬৮৮, ব্যাংক এশিয়ার শ্যামলী রিং রোড শাখার ০৮৬৩৪০০১৩৮২, ০৮৬৩৩০০০৩৯৩, ০৮৬৩৩০০০২৯০, ০৮৬৩৪০০১৩৮৩, ০৮৬৩৪০০১৩৮২, ০৮৬৩৩০০০১৯৩ ও ব্যাংক এশিয়ার এসএমই সার্ভিস শাখার ১৫৯৩৬০০০০১১, ০১৫৯৩৪০০৪৬৮১, ১৫৯৩৩০০০৯২৯ হিসাবে এসব অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি এই বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেনের বৈধ কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।

এ ছাড়া শামীমের মা আয়েশা আক্তারের নামের ট্রাস্ট ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ শাখায় ৩০৬৮৪০১৪৮১৯ হিসাবে ২৫ কোটি, ০০৩৫০৩৩০০২১৫২৩ নম্বর হিসাবে ২৫ কোটি, ০০৩৫০৩৩০০২১৫৩২ এই নম্বরে ২৫ কোটি, ০০৩৫০৩৩০০২১৫১৪ নম্বর হিসাবে ২৫ কোটি, ০০৩৫০৩৩০০২১৫০৫ হিসাবে ২৭ লাখ ৬০ হাজার, ট্রাস্ট ব্যাংক কেরানীগঞ্জ শাখার ০০৬৫০৪৭১০০০২৭৫ হিসাবে ২৫ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক মহাখালী শাখায় ৪০৩৮৫৩৮০০০০০২৮৮ হিসাবে ১০ কোটি, ৪০৩৮৫৩৮০০০০০২৮৯ হিসাবে ১০ কোটি, ৪০৩৮৫৩৮০০০০০৩০০ হিসাবে ১০ কোটি, ৪০৩৮৫৩৮০০০০০২৮৩ হিসাবে ১০ কোটি টাকার এফডিআর করা হয়। তার মায়ের নামে  মোট ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকার এফডিআর পাওয়া যায়।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, জি কে শামীমের ঠিকাদারি জগতে উত্থান জামাল অ্যান্ড কোংয়ের মাধ্যমে। যার মালিক নোয়াখারীল জামাল হোসেন। জি কে শামীম ও জামাল সিন্ডিকেট করে নোয়াখালীতে বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং ইনস্টিটিউট, মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজের টেন্ডার পান। জামাল ও জি কে উভয় প্রতিষ্ঠারনর দেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

জানা গেছে, ট্রাস্ট ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখায় প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেডের সঙ্গেও যৌথভাবে একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় (নম্বর ০০৩৫০২১০০০৩০০১)। অনেক প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিতে মূলত প্রজেক্ট বিল্ডার্সের লাইসেন্স কাজে লাগায় জি কে বিল্ডার্স। প্রজেক্ট বিল্ডার্সের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ আনা হলেও প্রজেক্ট বিল্ডার্সকে কানাকড়িও দেওয়া হয়নি। পদ্মা অ্যাসোসিয়েট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড বা পায়েল নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অনেক নির্মাণকাজ করে জি কে। পায়েলের মালিক মিনারুল চাকলাদার। তার বাড়ি যশোর।

র‌্যাব জানায়, জি কে শামীমকে স্থানীয় সাক্ষীদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম। এ সময় তিনি স্বীকার করেন বিদেশে পাচারের জন্য নিজের অফিস কক্ষে বিপুল অঙ্কের অর্থ মজুদ করেন। তার ৭ দেহরক্ষী আগ্নেয়াস্ত্রের বৈধ লাইসেন্সধারী হলেও নিয়ম ভেঙে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টিতে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করেন বলে নিজেরাই স্বীকার করেন।

ইনিউজ ৭১/এম.আর