কোটি টাকা না হলে প্রতারণা করেন না আনসারী !

নিজস্ব প্রতিবেদক
ইনিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: বুধবার ৭ই সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:২৬ অপরাহ্ন
কোটি টাকা না হলে প্রতারণা করেন না আনসারী !

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় অফিস নেন তিনি। ভেতরের সাজসজ্জা করপোরেট অফিসকেও ছাড়িয়ে যায়। নিজেকে বড় ঠিকাদার পরিচয় দেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকার নির্মাণসামগ্রী ও গরু সংগ্রহ করেন। প্রথম দুই-তিনটি চালানের দাম ঠিকঠাক দেন। একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে এভাবে বিভিন্ন সামগ্রী ও পণ্য সংগ্রহ করেন। এরপর সেগুলো কম দামে আবার অন্য ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেন। এভাবে কয়েক ধাপের চালান লেনদেন করে কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অফিস ছেড়ে উধাও হয়ে যান। গরু ব্যবসায়ী, রড ব্যবসায়ীসহ দেশব্যাপী বড় ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে প্রতারণাই তার কাজ! এসব অভিযোগ উঠেছে আমান আনসারীর (৪০) বিরুদ্ধে। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল। বলা হচ্ছে, প্রতারণা করতে দেশের প্রভাবশালীদের নাম ও পরিচয়ও ব্যবহার করে চলেছেন এই ব্যক্তি।


এবছরের শুরুর দিকে মগবাজারের রড ব্যবসায়ী দেওয়ান আল মাসুদ তার ফেসবুক আইডি দিয়ে রড বিক্রির একটি বিজ্ঞাপন দেন। কারখানা থেকে সরাসরি সুলভমূল্যে রড বিক্রির এই বিজ্ঞাপণ দেখে অনেক ক্রেতা ও ঠিকাদার আগ্রহ দেখান। ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে তরিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি আল মাসুদের ব্যবাসয়িক প্রতিষ্ঠানে আসেন।


আল মাসুদ বলেন, ‘তরিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি এসে আমাকে বললেন, তার সঙ্গে এক ঠিকাদারের পরিচয় রয়েছে। যার অফিস গুলশানে। তিনি সরকারের ব্রিজ, কালভার্ট, সড়কের কাজ করেন। প্রতি মাসে তার এক হাজার টন রড প্রয়োজন। আমি তার (তরিকুলের) বর্তমান সাইট টঙ্গির ওদিকে দেখে এসেছি। আপনার এখান থেকেও রড নিতে পারে। শান্তি নগরে তার বাড়ি রয়েছে। মাসে আড়াইলাখ টাকা ভাড়া পায়। তার নাম আমান আনসারী। তার প্রতিষ্ঠানের নাম মেসার্স ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনাল।’


তরিকুল ইসলাম কথা বলে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর আমান আনসারী গত ২০ ফেব্রুয়ারি ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকার রড নেন। এসময় ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। দেওয়ান আল মাসুদের প্রতিষ্ঠান থেকে এভাবে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমান আনসারী দুই কোটি ৬৩ লাখ টাকার রড নেন। তবে ৮২ লাখ টাকা আটকে দিয়ে আমান উধাও হয়ে যান।


আল মাসুদ বলেন, ‘সে মাল নিয়ে টাকা পেন্ডিং করে করে দিতে শুরু করলো। আমি বাকি সাধারণত দেই না। কিন্তু সে তার নিজের বাড়ি টাঙ্গাইল বলেছে। আমার বাড়িও টাঙ্গাইল। তাই আমি দিয়েছি। কিন্তু ৮২ লাখ টাকা আটকে দেওয়ার পর সে টাকা দিচ্ছে না। সে বলল তার বিল হয়নি ঠিকাদারি কাজের বিল হলে টাকা দেবে। এই বলে আরও মাল নিতে চাইলো। কিন্তু আমি দিতে রাজি হলাম না। এরপর সে গা ঢাকা দেয়। আমি তাকে খুঁজতে থাকি। অফিসেও গিয়েও শুনলাম সে অফিস ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে, তাও কেউ বলতে পারে না। বহু দেন দরবার করে তাকে একবার হাজির করলাম। পরে সে ১৭ লাখ টাকার একটা চেক দিলো, কিন্তু টাকা পেলাম না। এরপর আমি আদালতে মামলা করি। কিন্তু তাকে পুলিশ কোথাও খুঁজে পায় না। কারণ সে যে ঠিকানা দিয়েছিল, সেগুলো সঠিক ছিল না।’


আল মাসুদের করা মামলায় আদালত আমান আনসারীর বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে। পরে খবর নিতে নিতে ও পুলিশের তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে আমান আনসারীকে রবিবার (৪ সেপ্টেম্বর) রাতে গ্রেফতার করে গুলশান থানা পুলিশ।


আমান আনসারী তার জাতীয় পরিচয় পত্রে স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করেছেন রাজধানীর রমনা এলাকায়। তবে সেখানে তার পূর্বপুরুষ বা নিজে কখনই বসবাস করেননি। সেখানে তার কোনও সম্পত্তিও নেই। তার প্রকৃত গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল।


পুলিশের দাবি, গ্রেফতারের পর জানা গেছে আমান আনসারী অসংখ্য মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। আল মাসুদের কাছ থেকে নেওয়া রড তিনি মহসিন নামে খিলক্ষেতের এক রড ব্যবায়ীর কাছে প্রতিটন ষাট হাজার টাকা কমে বিক্রি করে নগদ টাকা নিতেন। সব রড তিনি এই দোকানে দিয়েছেন। তাকে আরও রড দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকেও ৩৫ লাখ টাকা অগ্রীম নেন। সেই টাকা আর ফেরত দেননি। রড ব্যবসায়ী মহসিনও তাকে আর খুঁজে পাননি।


মহসিন হোসেন বলেন, ‘২০২০ সালের মাঝামাঝি এক মার্কেটিংয়ের লোক আসে আমার দোকানে। এসে সে জানায়, তারা বর্তমান মূল্যের চেয়ে এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা কমে প্রতিটন রড দিতে পারবে। এর কিছুদিন পর আমান আনসারী নিজে আসে। মার্কেটের চেয়ে এক হাজার টাকা কমে রড হয়তো দিতে পারে, ভেবে আমি তার কাছ থেকে রড নেওয়া শুরু করি। কয়েকবার রড দিয়েছে, আমিও তাকে টাকা দিয়ে দিয়েছি। একবার সে আমাকে বলে, পাঁচ হাজার টাকা কমে কয়েক টন রড পাওয়া যাবে, তবে অগ্রীম টাকা দিতে হবে। এটা বলে আমার কাছ থেকে অগ্রিম ৩৫ লাখ টাকা নিয়ে যায়। তবে আর রড দেয়নি। এরপর আমি অনেকবার তার গুলশানের অফিসে গিয়েছি। কিন্তু সে টাকা দেবে দেবে করে ঘুরিয়েছে। আর টাকা ফেরত দেয়নি। এরপর সে অফিস ছেড়ে চলে যায়।’


এই ঘটনায় আমান আনসারীর বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। তিনিও মামলা করবেন বলে ভাবছেন।


কুড়িগ্রাম ও কিশোরগঞ্জের দুই উদ্যোক্তা ঢাকায় গরুর খামার চালান। তাদের কাছ থেকে কয়েক ট্রাক গরু নিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আমান আনসারীর বিরুদ্ধে। তার কারণে পথে বসে গেছেন বলে দাবি এই দুই ব্যবসায়ীর। এদের মধ্যে কুড়িগ্রামের গোলাম হোসেন অন্তর পাবেন ১৭ লাখ ৪৬ হাজার এবং জুয়েল পাবেন ২১ লাখ টাকা।


গোলাম হোসেন অন্তর বলেন, “সেনা সদরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গরু সরবরাহ করার কথা বলে আমার কাছ থেকে গরু নিতো আমান। প্রথমে টাকা দিলেও একদিন পরে টাকা দেবে বলে তিন-চার ট্রাক গরু নেয়। এতে আমার ১৭ লাখ টাকা বিল আসে। কিন্তু সে আর বিল দেয়নি। আমি এলাকা থেকে লোন করে এবং গরু এনে ঢাকায় বেরাদিয়ায় খামার করেছি। আমার খামারের নাম ‘আরএপি অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেড’। আমি গ্রামে লোন করেছি, এখন তাদের টাকা দিতে পারছি না। খামারেও গরু তুলতে পারছি না। পাওনাদারদের ভয়ে আমি গ্রামে যেতে পারছি না।”


কিশোরগঞ্জের জুয়েল রাজধানীর মিরপুরে থাকেন। বিভিন্ন হাট থেকে গরু কিনে বিক্রি করেন। তার কাছ থেকেও একইভাবে গরু নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন আমানের বিরুদ্ধে। তারাও এই থানায় জিডি করে রেখেছেন।


প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা:

আমান আনসারীর গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের বাসাইন থানার টেংগুরিয়াপাড়া গ্রামে। লেখাপড়া করেননি। কোনও রকম নিজের নাম লিখতে পারেন। তবে তার কথাবার্তা চালচলন দেখলে সহজে বোঝার উপায় নেই, তার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াকে বড় ভাই বলে পরিচয় দিতেন তিনি। এছাড়া খুলনার এক তরুণ ও প্রভাবশালী সংসদ সদস্য তার বন্ধু বলেও পরিচয় দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন।


সর্বশেষ রাজধানীর গুলশানের অনন্যা হাউজিংয়ের ২৩/এ সড়কের ১ নম্বর বাড়ির ৫/বি ফ্ল্যাটে ৯৩ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে অফিস শুরু করে আমান আনসারী। পুলিশ বলছে, কোনও অফিসই তিনি এক মাসের বেশি থাকেন না। আবারও তিনি গুলশানের কোনও জায়গায় অফিস নিচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে।


আরও যত প্রতারণা:

বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে দাওয়াত পত্র দেওয়া হয়, সেসব দাওয়াত পত্রে নিজের নাম বসিয়ে ফেসবুকে সেগুলো প্রচার করতেন আমান। নিজেকে ক্ষমতাবান প্রমাণ করতেই ছিল এই প্রচারণা।


বঙ্গবন্ধু কল্যাণ পরিষদ নামে একটি সংগঠন করে নিজেকে স্বঘোষিত সভাপতি করেন আমান আনসারী। এই সংগঠনের বিভিন্ন এলাকায় কমিটি দিয়েও টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।


পুলিশের বক্তব্য:

রাজধানীর গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, ‘আমান আনসারীর বিরুদ্ধে আদালতের পরোয়ানা ছিল। সেই পরোয়ানায় তাকে ভাটারা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক জিডিও রয়েছে।’


মহসিন গুলশান থানায় যে জিডি করেন তার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) অমিত ভট্টাচার্য্য। তিনিবলেন, ‘জিডি হওয়ার পর আমি আমান আনসারীকে ডেকেছি। দুই পক্ষের কথা শুনে নিশ্চিত হয়েছি। মহসিন টাকা পাবে। সে টাকা দেওয়ার জন্য ওয়াদাও করেছিল। কিন্তু পরে অফিস নিয়ে সে হাওয়া হয়ে যায় টাকা ফেরত দেয়নি। ‘


তিনি বলেন, ‘আমি ভুক্তোভোগীকে আদালতে মামলা করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলাম।’ তবে মহসিন বলেন, জিডি করার পর আমান আনসারী লোকজন নিয়ে আমাকে হুমকি দিতো।’


সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন