কক্সবাজারের টেকনাফের দুর্গম পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা মানবপাচারকারীদের আস্তানায় র্যাব-বিজিবি, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর যৌথ অভিযানে মুক্ত করা হয়েছে ৮৪ জন ভুক্তভোগীকে। একই অভিযানে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মানবপাচারকারী চক্রের ৩ সদস্যকে আটক করা হয়েছে। সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান বিজিবি ও র্যাব কর্তৃপক্ষ।
ভুক্তভোগীরা জানান, তাদের মধ্যে কেউ অপহৃত হয়েছেন, আবার কেউ স্বেচ্ছায় মালয়েশিয়া যাওয়ার আশায় পাচারকারীদের কাছে ধরা দিয়েছেন। অপহৃতদের পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে একসঙ্গে কয়েক দিন আটকে রাখা হতো। এসময় তাদের হাত-পা শিকল ও রশি দিয়ে বাঁধা থাকত। পাচারকারীরা ভয় দেখিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি, মারধর, লাথি-ঘুষি দিত এবং মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করত। মুক্তিপণ না পেলে সাগরপথে মিয়ানমার হয়ে মালয়েশিয়া অথবা থাইল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতো। দিনে এক বেলা অল্প খাবার দেওয়া হতো। নারী ও শিশুদের আলাদা স্থানে আটক রাখা হয়েছিল। টানা ১৮ দিন ধরে মশা, জোঁক ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন তারা।
বিজিবি সূত্রে জানা যায়, গত ২০ সেপ্টেম্বর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বাহারছড়া কচ্ছপিয়া এলাকার পাহাড়ে পাচারকারীদের অবস্থান শনাক্ত করা হয়। প্রথমে অভিযান চালিয়ে ১ পাচারকারী আটক ও ৪ জন ভুক্তভোগী উদ্ধার করা হয়। পরে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রাজারছড়া পাহাড় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় চিরুনি অভিযান চালানো হয়। এসময় পাচারকারীরা পালানোর চেষ্টা করে এবং যৌথ বাহিনীর দিকে ৩ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এমনকি কয়েকজন জিম্মিকে পাহাড় থেকে ঠেলে দেওয়ার মতো নৃশংসতাও চালায় তারা। তবে যৌথ বাহিনী পাল্টা গুলি না চালিয়ে কৌশলগতভাবে এলাকা ঘিরে অভিযান চালিয়ে ভুক্তভোগীদের নিরাপদে উদ্ধার করে। প্রায় ১২ ঘণ্টার এ অভিযানে পাহাড় ও তার পাদদেশ থেকে মোট ৮৪ জনকে উদ্ধার করা হয়।
অভিযানে গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন— টেকনাফের বাহারছড়া গ্রামের আব্দুল্লাহ (২১), সদর ইউনিয়নের সাইফুল ইসলাম (২০) ও মো. ইব্রাহিম (২০)। এসময় তাদের কাছ থেকে একটি ওয়ান শুটার গান, একনলা বন্দুক, একটি বিদেশি পিস্তল, রামদা, চাকু এবং তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়। তবে মূল গডফাদাররা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন রেজাউল করিম (৩৭), আয়াতুল তনজিদ (৩০)সহ আরও কয়েকজন।
র্যাব-১৫ অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল হাসান জানান, ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও দীর্ঘ তদন্তের মাধ্যমে পাচারকারীদের গোপন আস্তানা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই এই অভিযান চালানো হয়। তিনি আরও বলেন, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মাদক ও মানবপাচার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে জানান, “যে কোনো অপতৎপরতা ও অপরাধীদের ধরতে এ ধরনের যৌথ অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
উল্লেখ্য, এর আগে গত বৃহস্পতিবার কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনী আরেক অভিযানে ৬৪ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করেছিল। সাম্প্রতিক কয়েকটি অভিযানে দেড় শতাধিক ভুক্তভোগীকে পাচারকারীদের কবল থেকে মুক্ত করা হয়েছে।
নাগরিক সমাজ মনে করছে, নিয়মিত যৌথ অভিযান ও মূল গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা গেলে টেকনাফ উপকূলে দীর্ঘদিনের মানবপাচার ও অপহরণের ভয়াবহ চক্র ভাঙা সম্ভব হবে।