প্রকাশ: ৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৫
বরিশালে চিকিৎসা সেবায় নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এখানকার ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের অবহেলা ও সঠিক চিকিৎসা না দেয়ায় মারা যাচ্ছে একের পর এক রোগী। সঠিক চিকিৎসা বা ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু ঘটলেও নিত্য নতুন ব্যানারে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে হাসপাতাল ও ক্লিনিক।
ঢাকঢোল পিটিয়ে সেইসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক উদ্বোধন করলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগী মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটেই চলছে। এসব ঘটনা ঘটলেও হাসপাতালগুলো তাদের কার্যক্রম বীরদর্পে চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারী) নগরীর সদর রোডস্থ বেঙ্গল হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল চিকিৎসায় আন্নি হাসান নামে এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন কার্যালয় ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় একাধিক ভূয়া কথিত কিছু চিকিৎসক ও নার্সদের কারনে ঘটছে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা বলে মনে করেন সচেতন মহল। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবী, কোন চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়।
বরিশাল নগরীর কাটপট্টি রোড এলাকার বাসিন্দা নিহত গৃহবধূ আন্নি হাসানের স্বামী সীমান্ত আব্দুল্লাহ জানান, তার অন্তঃসত্বা স্ত্রী আন্নি হাসান এর প্রসব ব্যাথা শুরু হলে মঙ্গলবার দুপুরে বরিশাল সদর হাসপাতালের ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডাঃ আফিয়া সুলতানার সাথে যোগাযোগ করেন।
তিনি আন্নি হাসানকে দ্রুত নগরীর সদর রোডের বেঙ্গল হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে আসতে বলেন। বিকাল সাড়ে ৩ টার দিকে হাসপাতালে ভর্তি করলে বিকাল সাড়ে ৪ টায় তার অস্ত্রোপচার হয়।
কিছুক্ষণ পরে অপারেশনের রুম থেকে রোগীর অবস্থা খারাপ বলে দ্রুত আন্নিকে শেবাচিমে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু শেবাচিমের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাকে দেখে মৃত ঘোষণা করেন। মৃতের পরিবারের দাবী আন্নির মৃত্যু বেঙ্গল হাসপাতালের অপারেশন রুমেই হয়। কিন্তু ডাঃ আফিয়া নিজেকে রক্ষার জন্য শেবাচিমে পাঠান।
এদিকে গৃহবধূর আন্নির মৃত্যুর পর চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পলাতক থাকায় মৃতের স্বজনরা হসপিটালে বিক্ষোভ ও ভাংচুরের চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।বরিশাল নগরীতে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়।
এর আগেও সরকারি হাসপাতাল ও প্রাইভেট হাসপাতালে একাধিক রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ২৮ এপ্রিল নগরীর ব্রাউন কম্পাউন্ড রোডে রয়েল সিটি হাসপাতালে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় সোনিয়া বেগম (২৪) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। তিনি ঝালকাঠি সদর উপজেলার বিনয়কাঠি ইউনিয়নের বাজিতপুর গ্রামের সাইফুল ইসলামের স্ত্রী। জানা গেছে, গত ২০ এপ্রিল রয়েল সিটি হাসপাতালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে সোনিয়া সন্তান প্রসব করে। ওই অপারেশন করেছিলেন ডা. তানিয়া।
২১ মে বরিশালের গৌরনদী পৌর এলাকার দক্ষিণ পালরদী মহল্লার আনোয়ারা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে ভুল চিকিৎসায় আফরোজা আক্তার মুন্নী (২৩) নামের এক প্রসূতি ও তার গর্ভজাত সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার পর পরই ক্লিনিক থেকে পালিয়ে গেছে কথিত চিকিৎসক ও আনোয়ারা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের মালিক হেদায়েত উল্লাহ। ভুল চিকিৎসায় মৃত প্রসূতি গৃহবধূ উজিরপুর উপজেলার শোলক ইউনিয়নের দত্তেস্বর গ্রামের কুদ্দুস তালুকদারের স্ত্রী।
১৩ আগস্ট বরিশাল নগরীর বেলভিউ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসকের অবহেলায় প্রসূতি নারী শাহনাজ পারভীনের (৪০) মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় বেলভিউ মেডিকেল সার্ভিসেসের ভুল আল্ট্রাসনোগ্রাম এবং চিকিৎসকদের অবহেলাকে দায়ী করছেন মৃতের স্বজনরা। মৃত শাহানাজ পারভীন জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার তরিকুল ইসলামের স্ত্রী।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোঃ হানিফ বলেন, হাসপাতাল ও ডাক্তার হচ্ছে মানুষের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। অসুস্থ মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য পরিপূর্ণভাবে আস্থা রাখেন ডাক্তারদের ওপর। কিন্তু হাসপাতাল ও ডাক্তাররা যদি দায়িত্বে অবহেলা করেন,
তবে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুরো চিকিৎসাসেবায়। তাই সরকারী এবং বেসরকারী উভয় রকমের হাসপাতালে সরকারের নজরদারী বাড়ানোর পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার কথা বলেন তিনি।
এ ব্যাপারে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান (বিপিএম-বার) ইনিউজকে বলেন, মূলতঃ এসব দেখভালের দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের। তবে কথিত বা ভূয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, কোন ভুক্তভোগী যদি আইনের আশ্রয় নেয় তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বরিশাল সিভিল সার্জন ডাঃ মনোয়ার হোসেন ইনিউজকে জানান, কোন ক্লিনিক বা হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু হলে তা তদন্ত সাপেক্ষে জানা যাবে আসলে চিকিৎসকের কোন ভুল ছিল কিনা। কথিত বা ভূয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লাইসেন্সবিহীন বা অবৈধ কোন হাসপাতাল ক্লিনিক গড়ে উঠলে কোনভাবেই তা বরদাস্ত করা হবে না। তবে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক দেখভালের দায়িত্ব পরিচালক স্বাস্থ্য মহোদয়ের বলেন তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি চিকিৎসকগণ তাদের নির্দিষ্ট ডিউটির পর প্রাইভেট চেম্বারে প্রাকটিস করতে পারেন।