মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে চা শ্রমিকের সন্তান হরিবল বোনার্জী জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন হলেও শিক্ষার আলো দিয়ে জয় করে এসেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর। এবার পালা উচ্চশিক্ষার। তাতেও দমেনি এই অদম্য মেধাবী। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ‘কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিট’-এ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) সন্ধা ৭টায় ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় ঢাবির ওয়েবসাইটে। এতে দেখা যায় হরিবল বোনার্জি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢবিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন।
হরিবলের এই ফলাফল চমকে দিয়েছে সবাইকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেও আনন্দ নেই তার পরিবারের। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে অনিল বোনার্জি ততই চিন্তিত হয়ে পড়ছেন। এ অবস্থায় ছেলেকে কীভাবে ভর্তি করাবেন সেই চিন্তায় দিন কাটছে তার।
এর আগে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ইনিউজ৭১ডটকমে ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হরিবলের ভর্তি পরীক্ষা অনিশ্চিত’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। তার অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর অক্লান্ত পরিশ্রম শিক্ষাক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরকে আলোকিত করলেও উচ্চশিক্ষায় এখন বাধ সেধেছে দরিদ্রতা। ভর্তিসহ পড়ালেখা চালানোর মতো কোনও সামর্থ্য নেই তার পরিবারের।
হরিবল বোনার্জী শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৯ নং সাতগাঁও ইউনিয়নের হুগলিছড়া চা বাগানের চা শ্রমিক অনিল বোনার্জি ও বিশোখা বোনার্জির ছেলে। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে হরিবল মেঝো। তার বড়বোন অঞ্জলি বোনার্জী বিবাহিত, থাকেন স্বামীর ঘরে। আর সর্বকনিষ্ট বোন রুবি বোনার্জী হরিবলের সাথেই ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতকার্য হয়েছে। জন্ম থেকে হরিবল দৃষ্টিপ্রতিন্ধী হলেও পড়ালেখায় খুব মেধাবী। চা-বাগানের দেওয়া সামান্য জমির ওপর বসত-ভিটায় জীবন কাটছে তাদের পরিবারের। হরিবল বোনার্জির বাবা অনিল বোনার্জি হুগলিছড়া চা বাগানের একজন চা শ্রমিক। সপ্তাহে একবার অল্প টাকা পান। আর টাকা দিয়েই সংসার চলে তাদের। দরিদ্রতা ও শারীরিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও হরিবল ২০২২ সালে এসএসসি ও ২০২৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর উচ্চতর শিক্ষালাভে হরিবলের প্রবল ইচ্ছা থাকলেও হতদরিদ্র বাবা অনিল বোনার্জির কোনও ইচ্ছা ছিল না ছেলেকে আর পড়ালেখা করানোর। কিন্তু অর্থাভাবে ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ছিলেন অনিশ্চিত। এবারের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ঢাবিতে পড়ালেখা অনিশ্চিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হরিবলের।
মেধাবী হরিবল বোনার্জি জানান, শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই ব্রেইল পদ্ধতির বই ছাড়া ক্লাসে শিক্ষকরা যা পড়াতেন তাই সে শুনে ও রেকর্ড করে নিয়ে এসে বাড়িতে মুখস্ত করতেন। টাকার অভাবে কোচিং করতে না পারলেও সহপাঠী, শিক্ষক ও অনেকের সহযোগিতায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভর্তির সুযোগ পয়েছেন। তাই তার ইচ্ছা, তিনি আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকতে চান না। স্বনির্ভর হতে চান। উচ্চশিক্ষা ছাড়া স্বনির্ভর হওয়া যায় না। এজন্য হরিবল সবার সহযোগিতা চান।
বাবা অনিল বোনার্জি বলেন, আমার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এটা শুনে সবাই খুশি হলেও আমি রয়েছি দুশ্চিন্তায়। চা বাগানে কাজ করে সপ্তাহে আমি অল্প কিছু টাকা পাই। যে টাকা পাই, তা দিয়ে সংসারই চলে না, ছেলের পড়ালেখার খরচ জোগাবো কিভাবে? এখন আমি কী করবো, ভেবে কোনও কুল কিনারা পাচ্ছি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, থাকা-খাওয়াসহ লেখাপড়ার খরচ চালানোর মতো সামর্থ আমার নেই। এজন্য সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা প্রয়োজন।
হরিবলের প্রাইভেট শিক্ষক আপন দাস বলেন, হরিবল আমার ছাত্র। তার সাথে পরিচয় মূলত আমি যখন হুগলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি তখন সে আমাদের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে ভর্তি হয়। দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও পড়ালেখার প্রতি হরিবলের প্রচণ্ড আগ্রহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় হরিবলা যে রেজাল্ট করেছে তা অকল্পনীয়। ওর এই রেজাল্ট অন্য শিক্ষার্থীদেরও অনুপ্রেরণা যোগাবে। পড়ালেখার সুযোগ পেলে হরিবল সমাজের বোঝা নয়, দেশের সম্পদ হবে। হরিবলের স্বপ্ন হচ্ছে সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করা।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।