মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ৪০ বছর ধরে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে শিশু উদ্যানটি। শহরের জয়নগর আবাসিক এলাকা ও ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ সংলগ্ন উদ্যানে এখন পর্যন্ত নির্মাণ হয়নি শিশু উপযোগী কোনো স্থাপনা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উদ্যানের সীমানা প্রচীরের একটি অংশ সম্পূর্ণ ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে। কয়েকটি স্থানে সীমানা প্রাচীর হেলে পড়েছে এবং একাধিক স্থান ধসে পড়েছে। উদ্যানের প্রবেশদ্বারে লোহার রডগুলো ভেঙে আঁকাবাঁকা হয়ে আছে।
বসার জন্য বানানো সিমেন্টের তৈরি কয়েকটি বেঞ্চ ভেঙে গেছে। উদ্যান মাঠে জমে আছে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। ঘাস ও লতাপাতায় ছেয়ে গেছে বেশ কিছু স্থান। বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টি হলে প্লাবিত হয় উদ্যানের মাঠ। ছোট-বড় গর্ত থাকায় মাঠে নেই খেলার পরিবেশ। প্রতিনিয়তই গরু-ছাগল চষে বেড়াচ্ছে উদ্যানের মাঠজুড়ে। তিন যুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও উদ্যানের সীমানা প্রাচীর ও কয়েকটি বেঞ্চ নির্মাণ ছাড়া লাগেনি উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮৩ সালে শ্রীমঙ্গলে একটি শিশু উদ্যান প্রতিষ্ঠার দাবিতে স্থানীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গণমান্য ব্যক্তিবর্গরা উপজেলা এবং পৌরসভা কর্তৃপক্ষের সাথে একাধিকবার মতবিনিময় সভা করেন। স্থানীয়দের জোরালো দাবির প্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরকারি ডিসি খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত শহরের জয়নগর পাড়ায় ৫ কেয়ার (১৫০ শতক) জমি একশ্রেণির ভূমিখেকোদের হাত থেকে রক্ষা করে শিশু উদ্যানের নামে বরাদ্দ দেন। তবে শিশু উদ্যানের গেটের সামনে থাকা একটি নাম ফলকে উদ্যান প্রতিষ্ঠান তারিখ ১৯৮৪ সাল লেখা রয়েছে।
১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদ গঠন হওয়ার পর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে পার্কের চারদিকে দেওয়া হয় বাউন্ডারি। পাশাপাশি সিমেন্টের কিছু বেঞ্চও তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে এ উদ্যানের ৬০ শতক জায়গা শিল্পকলা একাডেমির নামে দেওয়া হয়। শিল্পকলার নামে বড় অংকের বরাদ্দ আসলেও হয়নি দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন। শিল্পকলার নামে আসা সরকারি বরাদ্দও লুটে খাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা।
উপজেলার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের উদ্যোগে স্থানীয় সমাজসেবকদের সহযোগিতায় উদ্যান মাঠে তৈরি করা হয়েছিল একটি মুক্তমঞ্চ। এ মুক্তমঞ্চেই প্রতি বছর বৈশাখী ও বিজয় মেলা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে বৈশাখি এবং বিজয় মেলার আয়োজন হলে আয়োজকরা অনেক টাকা হাতিয়ে নিলেও শিশু উদ্যানের ফান্ডে জমা দেননি কোনো অর্থ। বিশাল অংকের অর্থ মেলা ও উদ্যান কর্তৃপক্ষরা ভাগ-ভাটোয়ারা করে খেয়ে ফেলেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায় ২০১১ সালে উদ্যানের মাঠে বিজয় মেলা চলাকালে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ মেলা পরিদর্শনে গিয়ে এই শিশু উদ্যানের নাম ‘শেখ রাসেল শিশু উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
জানতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অনুশীলন চক্রের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সাবেক সহ-সভাপতি কাওসার ইকবাল বলেন, শিশু উদ্যানের এই জায়গাটি ছিল অর্পিত্ত জমি। একশ্রেণির ভূমি খেকোদের হাত থেকে এই খাস জমিটি উদ্ধার করেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নূর হোসেন।
এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগেই এই জমিটি শিশু উদ্যানের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৯৮৯ সালে আবার প্রভাবশালী ভূমি খেকোরা থাবা বসিয়েছিল শিশু উদ্যানের ভূমি তাদের দখলে নিতে। সেসময় বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এই উদ্যানের জমিটি টিকিয়ে রাখার জন্য ১৩৯৮ বাংলা সনে আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগী হয়ে শিশু উদ্যানে শুরু করি বৈশাখী মেলা।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালে শিল্পকলা একাডেমির ভবন নির্মাণের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ৬০ শতক জায়গা নির্ধারণ কর প্রস্তাব পাঠাতে বলে। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদ মোহাম্মদ ছাইদুল হক বিষয়টি নিয়ে সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। আমি প্রস্তাব করি উন্মুক্ত এই উদ্যানে শিল্পকলা একাডেমি ভবন নির্মাণের প্রস্তাব পাঠানোর জন্য। কিন্তু ডিসির খতিয়ানের এই জায়গাটি রিজিউমের মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত এটি বাস্তবায়ন করার জন্য দীর্ঘদিন আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এই উদ্যান মাঠের একাংশে উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ কলেজের নামে দখল করে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য তৈরি করা হয়েছিল একটি টিনশেড ভবণ।
বর্তমানেও এখান থেকে কলেজ সরিয়ে অন্যত্র নেয়া হলেও উদ্যান মাঠের টিনশেড ভবনটি অন্য একটি কেজি স্কুল দখল করে পাঠদান করাচ্ছে। উদ্যানের এ জমিটি দখল করার জন্য প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠী বারবার পায়তাঁরা করেছিল। এখনও সুযোগ সন্ধানী মহলের কুদৃষ্টি রয়েছে এই জমির প্রতি। অদৃশ্য কারণে ৪০বছরে এই শিশু উদ্যান উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত ছিল।
স্থানীয় ইকো ট্যুর গাইড শ্যামল দেব বর্মা বলেন, পর্যটকরা বিনোদনের জন্য চায়ের রাজ্য শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে আসেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শ্রীমঙ্গলেকোনো শিশু বিনোদন কেন্দ্র নেই। আমাদের সন্তানদের চিত্ত-বিনোদনের জন্য শিশু উদ্যানটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু সংস্কার ও উন্নয়নের অভাবে এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শ্রীমঙ্গলবাসীর প্রাণের দাবি সরকারি সহায়তায় যেন শিশু উদ্যানটি শিশু উপযোগী উদ্যান করা হয়।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম বলেন, সরকার শিশু উদ্যানের নামে জমি দিলেও কয়েক বছর পর উদ্যানটি এক শিশুর নামে নামকরণ করা হয়, যা খুব দুঃখজনক। আমরা উদ্যানের সাবেক নাম শ্রীমঙ্গল শিশু উদ্যান নামে পুনরায় দেখতে চাই।
লেখক গবেষক সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, শিশু উদ্যানটি যুগের পর যুগ পার হলেও হয়নি কোনো উন্নয়ন। সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সুদৃষ্টি দিলে এখানে শিশুদের উপযোগী একটি পরিপূর্ণ শিশু উদ্যান গড়ে উঠলে স্থানীয় শিশুদের কলকাকলিতে মুখর হবে উদ্যান প্রাঙ্গণ।
এ বিষয়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ ইসলাম উদ্দিন বলেন, এই শিশু উদ্যানের উন্নয়নে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। আমরা পরিকল্পনাগুলো দ্রততম সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠাবো। সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সাড়া পেলে পরিকল্পনা অনুযায়ী শিশু উপযোগী উদ্যান গড়তে কাজ শুরু করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।