‘আল্লাহকে লজ্জা করা’ কথাটি বলতে কেমন যেন শুনায়! অথচ প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন, ‘হে মানুষ! তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর। হাদিসে পাকে আল্লাহকে লজ্জা করার কথা বলেছেন। আল্লাহকে লজ্জা করা প্রসঙ্গে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসটি হলো-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন, ‘তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর। সত্যিকারের লজ্জা। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা অবশ্যই আল্লাহকে লজ্জা করি- আলহামদুলিল্লাহ।
তিনি বললেন, কথা সেটা নয়। বরং আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করার মর্মার্থ হলো এই যে-
>> তুমি তোমার মাথা ও যেগুলিকে সে জমা করে, তার হেফাযত কর।
>> তুমি তোমার পেট ও যেগুলিকে সে জমা করে, তার হেফাযত কর।
>> আর তোমার বারবার স্মরণ করা উচিৎ মৃত্যুকে ও মৃত্যুর পরে (কবরে) পচে-গলে যাওয়াকে।
>> আর যে ব্যক্তি আখেরাত কামনা করে, সে যেন দুনিয়ার বিলাসিতা পরিহার করে।
যে ব্যক্তি উপরোক্ত কাজগুলি করে, সে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থেই আল্লাহকে লজ্জা করে।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি ও মিশকাত)
হাদিস বর্ণিত লজ্জা ও ৪টি উদাহরণ থেকে যা বুঝে আসে তাহলো-
উল্লেখিত হাদিসটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থবহ। আল্লাহকে লজ্জা করার অর্থ হলো আল্লাহকে যথাযথ ভয় করা ও তার কথা মেনে নেয়া। তবে কোনো কিছু পাওয়ার আশায় কিংবা জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তির ভয় নয়। বরং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও একচ্ছত্র আধিপত্যকে মর্যাদা ও সম্মান করা। তার সামনে যেনতেন কথা বলার ক্ষেত্রে লজ্জা অবলম্বন করা।
মানুষ সব সময় তার চেয়ে বড় মর্যাদার মানুষ থেকে লজ্জা পায। অন্যদের লজ্জা পায় না। শিশুদের লজ্জা পায় না। কারণ অবুজ শিশু কোনো কিছুই বুঝে না। আবার পাগলকেও লজ্জা পায় না, কারণ পাগল ভালোমন্দে পার্থক্য করতে পারে না বা তার সাক্ষ্য কার্যকর হয় না।
মানুষ জ্ঞানহীন পশুকেও লজ্জা পায় না কারণ ওরা বাকশক্তিহীন। তারা অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে না।
সর্বোপরি কথা হলো মানুষ জ্ঞানী, উঁচু মর্যাদা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভয় পায়। তাই সব জ্ঞানীদের জ্ঞানী, সব ক্ষমতার উৎস আল্লাহ তাআলাকেই বেশি লজ্জা পাবে মানুষ। তিনিই লজ্জা পাওয়ার একমাত্র হকদার। তার সামনে যে কোনো মন্দ করতেই বান্দা লজ্জা পাবে, এটি স্বাভাবিক ও চিরাচরিত নিয়ম।
আল্লাহকে লজ্জা করার প্রধান ৪ বিষয় হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। যার প্রথমটি হলো-
মাথা ও যেগুলিকে সে জমা করে, তার হেফাযত কর।
এর দুটি দিক আছে। একটি হলো, মাথার সঙ্গে চুক্ত আছে চুল, কান, চোখ, নাক-মুখ ইত্যাদি। এগুলো যেমন পরিচ্ছন্ন ও যত্ন করার মাধ্যমে হেফাজত করতে হয় আবার এ মাথার দিয়ে আল্লাহকে ছাড়া আর কারও সামনে সেজদা করা থেকেও বিরত থাকতে হয়।
অর্থাৎ এ মাথা দিয়ে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সেজদা না করা। যে মানুষকে তিনি তার ইবাদতের জন্য বানিয়েছেন সে মানুষ যদি আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করে, সেটিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় লজ্জার বিষয়।
আল্লাহর হুকুমে মানুষের মাথা থেকে পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ হয়। তাই মাথা সংশ্লিষ্ট সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত না হওয়া। রিয়া বা অহংকার ও হিংসা বিদ্বেষের রোগ থেকে মুক্ত থাকা। বান্দার এসব কাজ আল্লাহর জন্য অনেক লজ্জার। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে তার জন্য লজ্জাজনক কাজ বান্দাকে পরিহার করতে হয়।
মাথার অন্যতম অংশ হলো মুখ, চোখ, কান এবং নাক। যা দ্বারা মানুষ কথা বলে, দেখে, শোনে এবং নিশ্বাস নেয়। যার সবগুলোর সঙ্গে অহরহ গিবত ও অপবাদ, জেনাসহ নানান অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। বান্দার এসব কাজও আল্লাহর জন্য লজ্জার। তাইতো হাদিসে আল্লাহ তাআলা লজ্জা করতে বলা হয়েছে। যাতে এ লজ্জায় মানুষের মাথা দ্বারা কোনো গোনাহ সংঘটিত না হয়।
দ্বিতীয়টি হলো- পেট ও তার মধ্যেকার সবকিছুকে হেফাজত করা।
হাদিসে উল্লেখিত এ কথার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- হারাম খাদ্য দ্বারা পেট না ভরা। পেটের সঙ্গে মানুষের হৃদয়, হাত-পা ও গোপনাঙ্গসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জড়িত। পেটকে আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত করতে হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলাকে লজ্জা করা।
মাথা ও পেটের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার দু’টি অঙ্গের গ্যারান্টি দিতে পারবে আমি তার জান্নাতের গ্যারান্টি দেব। আর তাহলো (মাথার মধ্যে) দুই চোয়ালের (মুখের) মধ্যবর্তী অঙ্গ- জিহ্বা এবং (পেটের সঙ্গে সর্ম্পকিত) দুই পায়ের মধ্যবর্তী গোপনাঙ্গ।’ (বুখারি ও মিশকাত)
তৃতীয়টি হলো- মৃত্যুকে ও তার পরে (কবরে) পচে-গলে যাওয়ার অবস্থাকে স্মরণ করা।
এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করবে। এটি আল্লাহ প্রেমিক বান্দার অন্যতম গুণ। কিন্তু মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় মৃত্যুকে বেমালুম ভুলে থাকে। মৃত্যুর পরে পচে-গলে যাওয়াও মানুষের জন্য একটি লজ্জাজনক বিষয়। তাই মানুষের উচিত বেশি বেশি মৃত্যুর স্মরণের মাধ্যমে পরকালের প্রস্তুতি ও দুনিয়ায় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে আখেরাতের সুন্দর জীবন কামনা করা। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা স্বাদ বিনষ্টকারী বস্তুকে (মৃত্যুকে) বেশি বেশি স্মরণ কর।’ (তিরমিজি, মিশকাত)
আর তাইতো মুমিন মুসলমানকে এ কারণেই জানাযায় অংশগ্রহণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। যাতে জানাযা ও মৃত মানুষের জানাযা ও দাফন-কাফনের দৃশ্য দেখে নিজের মৃত্যুর দৃশ্য স্মরণ করে। আর তা মানুষকে পাপ থেকে বিরত রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে।
হাদিসে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচক্ষণ মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে আরও বলেছেন, ‘যারা মৃত্যুকে অধিক স্মরণ করে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য সবচেয়ে সুন্দরভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করে (তারাই প্রকৃত মুমিন) ‘ (ইবনে মাজাহ)
চতুর্থটি হলো- আখেরাতকে কামনা করে, দুনিয়ার চাকচিক্য পরিহার করা।
দুনিয়ার লোভ-লালসা, বিলাসিত, আরাম-আয়েশ ভুলে গিয়ে সবকিছুর উপর পরকালীন জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ার (ভোগ-বিলাস) অন্বেষণে লিপ্ত থাকে, সে আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতের পাথেয় অন্বেষণে লিপ্ত থাকে, সে দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতএব তোমরা চিরস্থায়ী বস্তুকে পাওয়ার জন্য ক্ষণস্থায়ী বস্তুকে ক্ষতিগ্রস্ত কর।’ (মুসনাদে আহমদ, মিশকাত)
আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে নিজেকে নিয়োজিত রাখা আল্লাহর জন্য লজ্জার বিষয়। তাই বলে দুনিয়াকে বাদ দিয়ে আখেরাত লাভ করাও সম্ভব নয়। কেননা হাদিসে এসেছে, ‘দুনিয়া হচ্ছে আখেরাতের শস্যক্ষেত্র।’ তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত সৌন্দর্য বা বিলাসিতা পরিহার না করাই উত্তম। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘তুমি তোমার পার্থিব অংশ ভোগ করতে ভুলো না।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ৭৭)
মুমিন মুসলমানের উচিত, হজরত আব্দুল্লাহকে দেয়া প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নসিহতের ওপর যথাযথ আমল করা। তবেই বান্দার জন্য সব কাজ সহজ হয়ে যাবে। আর তাহলো-
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘হে আব্দুল্লাহ! তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে থাক যে, তুমি একজন আগন্তুক বা মুসাফির।’ (বুখারি, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। সব কাজে আল্লাহকে লজ্জা করার তাওফিক দান করুন। সব গোনাহ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।