কোনো কাজ সৎকর্ম কিনা তা নির্ধারিত হয় কর্তার দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়তের উপর। ইসলামের দৃষ্টিতে সৎকর্মের মর্যাদা শুধু কর্মের ফলাফলের উপর নয় বরং তার পেছনে কর্তার নিয়ত বা দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। এককথায় নিয়ত বা দৃষ্টিভঙ্গি হলো সৎকর্মের অঙ্কুর। যে কোন কাজ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে নিয়ত বা দৃষ্টিভঙ্গি বিশুদ্ধ হতে হবে অর্থাৎ শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজটি সম্পাদিত হতে হবে। নিয়ত বা দৃষ্টিভঙ্গিই সৎকর্মকে প্রচলিত সমাজসেবামূলক কার্যক্রম বা Charity থেকে পৃথক করে দেয়। সাধারণ মানুষ কাজের ধরণ বা ফলাফল দেখে মূল্যায়ন করে আর আল্লাহ কাজের পেছনে সুপ্ত বাসনা, অন্তরের গতিবিধিকে প্রত্যক্ষ করে মূল্যায়ন করেন কেননা তিনি অন্তর্যামী।
দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত বিশুদ্ধ হলে অর্থাৎ শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন কাজ শুরু করার পর যদি কাঙ্ক্ষিত ফল নাও পাওয়া যায় তাহলেও তা আল্লাহর কাছে সৎকর্ম বলে গৃহীত হবে। হাদীসে একথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে প্রতিটি কাজ নিয়ত বা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। ওমর ইবনে খাত্তাব হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন- যত কাজ আছে সবই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং যার হিজরত দুনিয়া লাভের বা কোনো নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যে হবে। (বুখারী)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি পার্থিব বা দুনিয়ার কোন বিনিময় বা প্রতিদান লাভের উদ্দেশ্যে হিজরতের মতো কষ্টদায়ক ইবাদাত করবে সে আল্লাহর কাছে পরকালে কিছুই পাবে না। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই সৎকর্মের কলেবর বৃদ্ধি করার চাইতে দৃষ্টিভঙ্গি পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে সৎকর্মের ভিত্তি মজবুত করার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি বিশুদ্ধ করার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করলে সামান্য সৎকর্মই পরিত্রাণের জন্য যথেষ্ট হবে। রাসূল (সা.) মুয়ায বিন জাবাল (রা.)কে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, আপন নিয়ত বা দৃষ্টিভঙ্গিকে সবসময় সংমিশ্রণ থেকে পাক (মুক্ত) রেখো; যে আমল কর তা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কর তাহলে সামান্য আমলই তোমার পরিত্রাণের জন্য যথেষ্ট হবে। (তারগীব, তারহীব)
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যে কাজ কিছুটা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবং কিছুটা পার্থিব লাভের উদ্দেশ্যে করা হয় তার বিনিময়ে আল্লাহ কি দেবেন আর তা কি সৎকর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে? কেউ যদি ইহজীবনে সামাজিক স্বীকৃতি, ইলেকশনে জয়লাভ, জাতীয় সম্মান অর্জন করা ও সঙ্গে সঙ্গে পরজীবনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যে জনকল্যাণমূলক কাজ করে থাকেন তাহলে তা কি সৎকর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে? তার বিনিময় কি আল্লাহ পরকালে দেবেন? আল্লাহ তার রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে এর উত্তর বলে দিয়েছেন।
এক ব্যক্তি নবীজীর কাছে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, একজন লোক আখেরাতে প্রতিদান পাবার উদ্দেশ্যে ও দুনিয়াতে প্রশংসা পাবার উদ্দেশ্যে জিহাদ করতে থাকে সে কি সওয়াব পাবে? রাসূল (সা.) বললেন, সে কিছুই পাবে না। প্রশ্নকর্তা তিনবার প্রশ্ন করলে, রাসূল (সা.) তিনবারই একই উত্তর দেন। অবশেষে রাসূল (সা.) বললেন, আল্লাহ কেবলমাত্র সেই আমল কবুল করবেন, যা কেবল তার জন্যই করা হয়ে থাকে এবং তার সন্তুষ্টি ওই আমলের সঞ্চালক হবে। (আবু দাউদ, নাসায়ী)
নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে কর্মের বহর যত বেশিই হোক না কেন তা নিস্ফল হয়ে যাবে। আর যদি নিশ্চিত হোন যে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করছেন, তাহলে আদাজল খেয়ে লেগে যান, অফুরন্ত পুরস্কার পাবেন। বিশুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যে কাজই করবেন তাতে প্রাকৃতিক আনুকূল্য পাবেন, অফুরন্ত শক্তি পাবেন, স্বর্গীয় আনন্দ ও প্রশান্তি পাবেন, প্রাচুর্যের সন্ধান পাবেন, স্রষ্টার সান্নিধ্য পাবেন ইহজীবনে ও পরজীবনে।
যারা মানুষের কাছ থেকে কোন বিনিময় বা কৃতজ্ঞতা আশা না করে শুধুমাত্র স্রষ্টার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কাজ করে তাদের লক্ষ্য্ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আহার্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম, বন্দীকে সাহায্য দান করে তারা বলে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে সাহায্য দান করি; আমরা তোমাদের নিকট থেকে প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা চাই না। আমরা আশঙ্কা করি পালনকর্তার নিকট হতে ভীতিপ্রদ ও ভয়ঙ্কর দিনের। পরিণামে আল্লাহ তাদের সে দিনের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন এবং তাদের দেবেন উৎফুল্লতা ও আনন্দ। (সূরা দাহর ৭৬: ৮-১১) অর্থাৎ একমাত্র একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর প্রেমে করা প্রতিটি কাজই মানুষকে দিতে পারে চিরস্থায়ী মুক্তি, প্রশান্তি, নিরাপত্তা, উৎফুল্লতা ও আনন্দ। কেননা আল্লাহ কাজ নয়, কাজের পেছনে ক্রিয়াশীল মনকে দেখেন।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।