মাহে রমজানে রাত্রিকালে এশার নামাজের চার রাকাত ফরজ ও দুই রাকাত সুন্নতের পর এবং বিতর নামাজের আগে দুই রাকাত করে ১০ সালামে যে ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, একে ‘তারাবি নামাজ’ বলা হয়। আরবি ‘তারাবিহ’ শব্দটির মূল ধাতু ‘রাহাতুন’ অর্থ আরাম বা বিশ্রাম করা। তারাবি নামাজ পড়াকালে প্রতি দুই রাকাত বা চার রাকাত পরপর বিশ্রাম করার জন্য একটু বসার নামই ‘তারাবি’। দীর্ঘ নামাজের কঠোর পরিশ্রম লাঘবের জন্য প্রতি দুই রাকাত, বিশেষ করে প্রতি চার রাকাত পর একটু বসে বিশ্রাম করে দোয়া ও তসবিহ পাঠ করতে হয় বলে এ নামাজকে ‘সালাতুত তারাবিহ’ বা তারাবি নামাজ বলা হয়।
আসুন জেনে নেই তারাবীহ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসআলা
১। যে রাতে রমজানের চাঁদ দেখা যাবে সে রাত থেকে তারাবীহ নামাজ শুরু করতে হবে। ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেলে তারাবীহ বন্ধ করতে হবে। তারাবী নামাজের সময় এশার নামাজের পর থেকে শুরু হয় এবং ফজরের সময় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত থাকে। যদি কী এশার নামাজের পূর্বে তারাবী পড়ে তাহলে তাহলে তা দুরস্ত হবে না।
২। তারাবীহ বাদ গেলে এর ক্বাজা নেই। পরবর্তিতে ক্বাজা পড়ে নিলে তারাবীহ হবে না, বরং নফল, মুস্তাহাব হবে। যেমন মাগরিব ও এশার সুন্নত সমূহ।(দুররুল মোখতার, রদ্দুল মোহতার)
৩। তারাবীহর সময় এশার ফরজের পর থেকে ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত। বিতিরের পূর্বে ও হতে পারে এবং পরেও হতে পারে। যদি কয়েক রাকাত বাকি থাকে, ইমাম বিতিরের জন্য দাঁড়িয়ে যায় তখন ইমামের সাথে বিতির পড়ে নেবে। অতঃপর বাকি নামাজ আদায় করে নেবে যদি ফরজ জামাতের সাথে পড়ে থাকে। আর এটা হলো উত্তম। যদি তারাবীহ পূর্ণ করে বিতির একাকী পড়ে তখনও জায়েয। যদি পরে জানা যায় যে, এশার নামাজ অজু ব্যতীত পড়া হয়েছে এবং তারাবীহ ও বিতির অজু সহকারে পড়ে থাকলে এশা ও তারাবীহ পুনরায় পড়বে, তবে বিতির হয়ে যাবে। (দুরুল মোখতার, রদ্দল মোহতার)
৪। তারাবীহ বিশ রাকাত দশ সালামে আদায় করবে, অর্থাৎ প্রত্যেক দু’রাকাত পর সালাম ফিরাবে, কেউ বিশ রাকাত পড়ে শেষে সালাম ফিরাল-যদি প্রত্যেক দু’রাকাতে বসে থাকেও হয়ে যাবে। কিন্তু মাকরূহ হবে আর যদি দু’ রাকাতের বৈঠক না করে থাকলে তখন দু’রাকাতের স্থলাভিষিক্ত হবে। (দুররুল মোখতার)
৫। তারাবীহ নামাযে খতমে কুরআনের বিধান:
(ক)। তারাবীহের মধ্যে একবার কুরআন মাজীদ খতম করা সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ এবং মানুষের অলসতার কারণে খতম পরিত্যাগ করবে না। (দুররুল মোখতার ১ম খ-, ৯৮ পৃষ্ঠা)
(খ)। তারাবীহের মধ্যে একবার কুরআন মজীদ খতম করা সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। মানুষের অলসতার কারণে খতম পরিত্যাগ করবে না। )ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া ১ম খ- ১১৭ পৃষ্ঠা।
(গ)। বিশুদ্ধ অভিমত মোতাবেক রামযান মাসে তারাবীহর মধ্যে একবার পূর্ণ কোরআন শরীফ খতম করা সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। যদি জনগণ বিরক্তিবোধ করে, তাহলে পছন্দনীয় মাযহাব মোতাবেক এ পরিমাণ পড়তে থাকবে যা বিরক্তির কারণ না হয়। (নুরুল ইযাহ)
(ঘ)। তারাবীহর মধ্যে একবার কুরআন মজীদ খতম করা সুন্নাতে মোয়াক্কাদাহ। মানুষের অলসতার কারণে খতম পরিত্যাগ করবে না। (শরহে বেকায়াহ, পৃষ্ঠা-১৭৫)
তারাবীহর নামাযে এক খতম কোরআন পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। ‘খানিয়া’ ও আন্যান্য কিতাবে এই মতকেই সহীহ্ বলা হয়েছে।
তারাবিহ নামাযের প্রতি চার রাকাত পর নির্দিষ্ট কোন দোয়া দরূদ পড়ার কথা বিশুদ্ধ সূত্রে হাদীসে বর্ণিত হয়নি। কিন্তু চার রাকাত পর এতটুকু সময় বসা মুস্তাহাব, যতক্ষণ সময় চার রাকাত নামায পড়তে সময় লেগেছে। সেই সময় নফল নামায পড়া, তাসবীহ পড়া, দরূদ পড়া, জিকির করা, কুরআন তিলাওয়ত করা, কিংবা চুপ করে বসে থাকা, মক্কায় হলে তওয়াফ করা সবই জায়েজ। তবে হ্যাঁ, নির্দিষ্ট কোন একটি কাজকে আবশ্যকীয় মনে করার কোন সুযোগ নেই। সুযোগ নেই নির্দিষ্ট কোন দোয়াকে জরুরী মনে করা।
যেহেতু যেকোন দুআ ও দরূদ এ সময়ে পড়া যায়। সেই হিসেবে কিছু কিছু ফুক্বাহায়ে কেরাম এ সময়
سُبْحَانَ ذِي الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوتِ، سُبْحَانَ ذِي الْعِزَّةِ وَالْعَظَمَةِ وَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوتِ، سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ، سُبُّوحٌ قُدُّوسٌ رَبُّ الْمَلَائِكَةِ وَالرُّوحِ، لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ نَسْتَغْفِرُ اللَّهَ، نَسْأَلُك الْجَنَّةَ وَنَعُوذُ بِك مِنْ النَّارِ
হামদ ও ছানার এই দোয়াটি পড়তে বলেছেন।
এটা জরুরী, বা সুন্নত-মুস্তাহাব হিসেবে পড়তে বলেননি। বরং এসময় চুপ করে থাকার চেয়ে দোয়া দরূদ, জিকির আজকার করা উচিত। সেই হিসেবে তারা একটি চমৎকার আল্লাহর হামদ এবং দোয়ার শব্দময় উক্ত বাক্যগুলো পড়তে বলেছেন।
এটি পড়া যায়। কিন্তু সুন্নত-মুস্তাহাব বা জরুরী মনে করা যাবে না। পড়লেও অসুবিধা নেই, না পড়লেও কোনো সমস্যা নেই। আল্লাহ তাআ'লা আমাদেরকে রমজানের যাবতীয় বিধিনিষেধ মেনে চলার তাওফিক দান করুক। আমিন।
সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া মিল্লিয়া বাংলাদেশ।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।