মেসওয়াকের ফজিলত ও উপকারিতা বেশি কেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক
ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: রবিবার ২৫শে সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:০১ পূর্বাহ্ন
মেসওয়াকের ফজিলত ও উপকারিতা বেশি কেন?

সুন্নতে নববির অনন্য এক আমল মেসওয়াক। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম এটি। নবিজি বলেন, ‘জিবরিল আলাইহিস সালাম অহি নিয়ে এসেছেন আর মেসওয়াকের কথা বলেননি- এমনটি কখনো হয়নি। তাই অবস্থা এমন মনে হতো যেন, মেসওয়াক করতে থাকার কারণে আমার মুখের অগ্রভাগ ছিলে যায়। (বুখারি, মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত)


মানুষের প্রতিটি কাজে রয়েছে সুন্নাতে নববির দিক নির্দেশনা। নবিজি উল্লেখ করেছেন মেসওয়াকের নিয়ম-কানুন, পদ্ধতি, ফজিলত ও মর্যাদা। দুনিয়া ও পরকালের অগণিত কল্যাণ এবং উপকারিতাও রয়েছে মেসওয়াকে। মেসওয়াক কী? এর গুরুত্ব ইত্যাদি থেকে মেসওয়াকের উপকারিতা ফুটে ওঠে।


মেসওয়াক কী?


মেসওয়াক হলো গাছের ডাল বা শিকড়। যা দিয়ে দাঁত মাজা ও পরিষ্কার করা হয়। দাঁত মাজাকেও মেসওয়াক বলা হয়। হাদিসের নির্দেশনা মোতাবেক মেসওয়াক দ্বারা বুঝা যায়, মুখ ও দাঁত পরিষ্কার করা। গাছের ডালা বা শিকড় দিয়ে প্রত্যেক নামাজ ও ওজুর সময় দাঁত পরিষ্কার করাকে ইসলামে মেসওয়াক বলা হয়।


মেসওয়াকের গুরুত্ব


মেসওয়াক মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যম, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায়। (বুখারি, নাসাঈ, মিশকাত) অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এমনটি কখনো হয়নি যে, জিবরিল আলাইহিস সালাম আমার কাছে এসেছেন আর আমাকে মেসওয়াকের আদেশ দেননি। এতে আমার আশঙ্কা হচ্ছিল যে, মেসওয়াকের কারণে আমার মুখের অগ্রভাগ ছিলে না ফেলি। (মুসনাদে আহমদ, মিশকাত)


মেসওয়াক কী দিয়ে করতে হয়


যেসব গাছের স্বাদ তিতা সেসব গাছের ডাল দিয়ে মেসওয়াক করা মুস্তাহাব। যায়তুনের ডাল দিয়ে মেসওয়াক করা উত্তম। মেসওয়াক হাতের আঙ্গুলের মতো মোটা ও নরম হওয়া ভালো। লম্বায় হবে আধা হাত বা এক বিঘত।


মেসওয়াক করার পদ্ধতি


মুখের ডানদিক থেকে দাঁতের প্রস্থের দিকে উপরে-নীচে মেসওয়াক শুরু করা। মুখের দৈর্ঘ্যেও দিকে নয়। হজরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুও এমনটিই বলেছেন। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ডান পাশ থেকে মেসওয়াক শুরু করা। দাঁতের প্রস্থের দিক তথা দাঁতের উপর থেকে নিচ এবং নিচ থেকে উপরের দিকে মেসওয়াক করা। লম্বা-লম্বি তথা ডান থেকে বামে বা বাম থেকে ডানের দিকে মেসওয়াক না করা।


মেসওয়াক ধরার পদ্ধতি


হাতের মধ্যমা ও তর্জনি আঙুল থাকবে মেসওয়াকের উপর। কনিষ্ঠ ও অনামিকা আঙুল থাকবে মেওয়াকের নিচে। বৃদ্ধাঙুল ও শাহাদাত আঙুল দিয়ে মেসওয়াকের উপর-নিচ থেকে চাপ দিয়ে শক্তভাবে ধরতে হবে।


মেসওয়াক করার সময়


অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মতে, অজুতে কুলি করার আগে; কোনো কোনো ইসলামিক স্কলার ওজুর আগে মেসওয়াক করার কথা বলেছেন। এছাড়াও মুস্তাহাব হচ্ছে-


১. নামাজের আগে মেসওয়াক করা,


২. ঘুম থেকে ওঠার পর মেসওয়াক করা,


৩. কোনো মজলিসে যাওয়ার আগে,


৪. কোরআন ও হাদিস তেলাওয়াতের আগে মেসওয়াক করা,


৫. মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের আগে মেওয়াক করা।


৬. ঘরের প্রবেশ করে মেসওয়াক করা।


৭. মুখে দুর্গন্ধ ছড়ালে মেসওয়াক করা।


৮. দাঁতে হলুদ আবরণ বা ময়লাযুক্ত হলে মেসওয়াক করা।


৯. ক্ষুধা লাগলে মেসওয়াক করা।


১০. জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মেসওয়াক করা।


মেসওয়াকের উপকারিতা


১. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন, ‘মেসওয়াক করে যে নামাজ আদায় করা হয়, সে নামাজে মেসওয়াকবিহীন নামাজের তুলনায় সত্তরগুণ বেশি ফজিলত রয়েছে।’ (বায়হাকি)


২. মেসওয়াকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।


৩. মেসওয়াকে দারিদ্র্যতা দূর হয়ে সচ্ছলতা আসে এবং উপার্জন বাড়ে।


৪. পাকস্থলী ঠিক থাকে ও শরীর শক্তিশালী হয়।


৫. স্মরণশক্তি ও জ্ঞান বাড়ে, অন্তর পবিত্র হয় এবং সৌন্দর্য বাড়ে।


৬. ফেরেশতারা তার সঙ্গে মুসাফাহা করেন, নামাজে বের হলে সম্মান করেন, নামাজ আদায় করে বের হলে আরশ বহনকারী ফেরেশতারা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া করেন।


৭. মেসওয়াক করলে শয়তান অসন্তুষ্ট হয়।


৮. মেসওয়াক ব্যবহারকারী এ আমলের কারণে ফুলসিরাত বিজলীর ন্যায় দ্রæত পার হবেন এবং ডান হাতে আমলনামা পাবেন, ইবাদতে শক্তি পাবেন।


৯. মেসওয়াকের আমলে মৃত্যুর সময় কালিমা নসিব হবে, জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হবে এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হবে। পূত-পবিত্র হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে মেসওয়াককারী।


ঘন ঘন মেসওয়াক করার উপদেশ


১. নবিজি বলেছেন, মুমিন মুসলমানের প্রকৃতিগত কাজসমূহে একটি হলো- মেসওয়াক করে মুখ পরিষ্কার রাখা।’ (মুসলিম, মিশকাত)


২. নবিজি বলেছেন, ‘বিশেষ করে জুমআর দিন গোসল ও মেসওয়াক করা এবং আতর ব্যবহার করা একান্ত কর্তব্য। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারি, আবু দাউদ, জামে)


৩. নবিজি বলেন, ‘জিবরিল (আ.) আমাকে এতবেশি দাঁতন বা মেসওয়াক করতে আদেশ করেছেন, যাতে আমি আমার দাঁত ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা করছি।’


৪. অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘এতে আমার ভয় হয় যে, দাঁতন বা মেসওয়াক করা আমার উপর ফরয করে দেওয়া হবে।’ (জামে)


৫. নবিজি বলেন, ‘বাড়িতে প্রবেশ করেই তিনি প্রথম যে কাজ করতেন, তা হল দাঁতন বা মেসওয়াক করা।’ (মুসলিম)


৬. নবিজি আরও বলেন, ‘তাহাজ্জুদ পড়তে উঠলেই তিনি দাঁতন বা মেসওয়াক করেই দাঁত মাজতেন।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)


৭. নবিজি বলেন, নামাজ ছাড়াও রাতের অন্যান্য সময়েও যখন তিনি জেগে উঠতেন; তখনও মেসওয়াক করতেন। আর এই কারণেই রাতে শোয়ার সময় তিনি শিথানে মাথার কাছে দাঁতন বা মেসওয়াক রেখে নিতেন।’ (জামে)


মেসওয়াক বেশি প্রিয় হওয়ার কারণ


১. একবার হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁতন বা মেসওয়াক আনতে আদেশ করে বললেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বান্দা যখন নামাজ পড়তে দাঁড়ায়; তখন ফেরেশতারা তার পেছনে দাঁড়িয়ে কেরাত শুনতে থাকেন। ফেরেশতারা তার কাছাকাছি হতে থাকেন। পরিশেষে ফেরেশতা নিজ মুখ তার (বান্দার) মুখে মিলিয়ে দেন! ফলে তার মুখ হতে কোরআনের যেটুকুই অংশ বের হয় সেটুকু অংশই ফেরেশতার পেটে প্রবেশ করে। সুতরাং কোরআনের জন্য তোমরা তোমাদের মুখকে পবিত্র করো।’ (মুসনাদে বাযযার, তারগিব)


২. নবিজি বলেছেন, ‘মেসওয়াক করে তোমরা তোমাদের মুখকে পবিত্র করো। কারণ, মুখ হল কোরআনের পথ।’ (সিলসিলাহ)


৩. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেসওয়াক করে আমাকে তা ধুতে দিতেন। কিন্তু ধোয়ার আগে আমি মেসওয়াক করে নিতাম। তারপর তা ধুয়ে তাঁকে দিতাম।’ (আবু দাউদ, মিশকাত)


৪. নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মেসওয়াক এত প্রিয় ছিল যে, তাঁর ইন্তেকালের আগ মুহূর্তেও তিনি হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার দাঁতে চিবিয়ে নরম করে দেওয়া দাঁতন দিয়ে মেসওয়াক করেছেন।’ (বুখারি, মিশকাত)


নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেসওয়াক করার ক্ষেত্রে তিনি আরাক (পিল্লু) গাছের (ডাল বা শিকড়ের) দাঁতন বা মেসওয়াক ব্যবহার করতেন। (মুসনাদে আহমাদ)আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সব সময় মেসওয়াকের আমল করার তাওফিক দান করুন। হাদিসে ঘোষিত ফজিলত অনুযায়ী দুনিয়া ও পরকালের উপকারিতা পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।