শারীরিকভাবে অসম্পূর্ন মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগীতা প্রদর্শন ও তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও মূল্যায়ন করার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাদের প্রতি সম্মান, মর্যাদা, সহমর্মিতা দেখানো জোর দিকনির্দেশনা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। এ নির্দেশনার পেছনে রয়েছে সুন্দর একটি ঘটনা। যা থেকে প্রতিবন্ধী গুরুত্ব ও মর্যাদার বিষয়টি ওঠে এসেছে। কী সেই ঘটনা ও কোরআনের দিকনির্দেশনামূলক বর্ণনা?সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ জ্ঞান দান করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা । যা অন্য কোনো প্রাণীকে দেননি।। মানুষই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সমতা বিধান করে থাকে। কোরআন ও হাদিসে এসেছে সাম্যের সবিস্তার আলোচনা। যার মধ্যে সব ধরনের প্রতিবন্ধীরাও শামিল।
মানুষের মধ্যে কেউ কেউ জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী হয় আবার কেউ নানা দুর্ঘটনা ও অসুস্থতার কারণেও প্রতিবন্ধী হয়। সব ধরনের প্রতিবন্ধীর সঙ্গে উত্তম আচরণ এবং তাদের প্রতি উপকারের হাত বাড়িয়ে দেয়ার শিক্ষাই রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-
هُوَ الَّذِیۡ یُصَوِّرُکُمۡ فِی الۡاَرۡحَامِ کَیۡفَ یَشَآءُ ؕ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ
‘তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি ছাড়া অন্য কোনো (সত্যিকার) উপাস্য নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা ইমরান : আয়াত ৬)প্রতিবন্ধীদের কথা এলেই সুরা আবাসার সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়; যা প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করতে একনিষ্ঠ করে তোলে। তাফসিরে কবিরে এসেছে-
অন্ধ সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু যিনি বনি আমের ইবনে লুইয়ের গোত্রভুক্ত ছিলেন। একবার তিনি হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে এমন সময় হাজির হন, যখন তিনি মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ওতবা ইবনে রবিয়া, আবু জেহেল, আব্বাস ইবনে আবুল মোত্তালেব, উবাই ইবনে খলফ এবং উমাইয়া ইবনে খলফের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের জন্যে আহবান করছিলেন এবং তিনি আশা করছিলেন যে, তারা মুসলমান হয়ে যাবে।
ঠিক এমন সময় অন্ধ সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু বারবার এ কথা বলছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ আপনাকে যা শিখিয়েছেন, তা আপনি আমাকে শিখিয়ে দিন।’ যেহেতু তিনি অন্ধ, তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কার সঙ্গে কথা বলছিলেন।আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের কথার কারণে আলোচনার ব্যঘাত ঘটছিল। এ কারণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা মুবারাকে একটু বিরক্তির ভাব প্রকাশ পেয়েছিল, তখন আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করেন-
عَبَسَ وَتَوَلَّى - أَن جَاءهُ الْأَعْمَى - وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى - أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنفَعَهُ الذِّكْرَى - أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى - فَأَنتَ لَهُ تَصَدَّى - وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى وَأَمَّا مَن جَاءكَ يَسْعَى - وَهُوَ يَخْشَى - فَأَنتَ عَنْهُ تَلَهَّى كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ
‘তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কারণ, তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করলো। আপনি কি জানেন, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার উপকারে আসতো। বরং যে বেপরোয়া, আপনি তার চিন্তায় মশগুল। সে শুদ্ধ না হলে আপনার কোনো দোষ নেই। যে আপনার কাছে দৌড়ে এলো এমতাবস্থায় যে, সে ভয় করে, আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন। কখনও এরূপ করবেন না, এটা উপদেশবানী।’ (সুরা আবাসা : আয়াত ০১-১১)
কোরআনুল কারিমের এ দিকনির্দেশনার পর প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করেন এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়ে তাদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে থাকেন। প্রতিবন্ধীদের প্রতি ভালোবাসা দেখানো এবং সাহায্য সহযোগিতা করা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম আদর্শ। তিনি কর্মে তার বাস্তবায়ন করেছেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে সমান চোখে দেখতেন। যার প্রমাণ বহন করে হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু। যিনি বাকপ্রতিবন্ধী হওয়া সত্বেও মসজিদে নববির প্রথম মুয়াজ্জিন হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই অন্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে দেখতেন, তখন তাকে বিশেষ মর্যাদা দিতেন এবং বলতেন স্বাগতম সেই ব্যক্তির জন্যে, যার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাকে সতর্ক করেছেন। এরপর তাঁর কোনো প্রয়োজন আছে কিনা তিনি খোঁজ-খবর নিতেন।
হজরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই বার জিহাদে গমন করার সময় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে গেছেন। মসজিদে নববিতে তিনি তের বার নামাজের ইমামতি করেছেন। (তিরমিজি ও মুস্তাদরেকে হাকিম)
প্রতিবন্ধীদের প্রতি করণীয়
মানুষ হিসেবে প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন ও চলাফেরা করার অধিকার রয়েছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সবারই প্রতিবন্ধীদের অধিকারের প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়ার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কেননা প্রতিবন্ধী নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের বৈষম্য ও দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকে না।
তাই ইসলাম দুর্বল, অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের অধিকারের ব্যাপারে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ, পুনর্বাসন, বিনোদন তথা কর্মসংস্থান পাওয়ার পূর্ণ অধিকারের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্ধীদেরকে পরনির্ভরশীল না হয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে, দক্ষ কর্মীরূপে গড়ে তুলতে, সমাজের সর্বস্তরের লোকদের ঈমানি দায়িত্ব।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বান্দা যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করে, আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন।’ (মুসলিম)
তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নাও এবং বন্দীকে মুক্তি দাও।’ (বুখারি)সুতরাং মুমিন মুসলমানসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উচিত, সামর্থ্য অনুযায়ী স্থান কাল পাত্রভেদে প্রত্যেকে স্ব স্ব অবস্থানে থেকে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। কোরআন ও হাদিসের ওপর আমল করার চেষ্টা করা। প্রতিবন্ধীদের প্রতি দয়া ও মমতা দেখানো একান্ত আবশ্যক।
আল্লাহ তাআলা বিশ্বব্যাপী সবাইকে প্রতিবন্ধীদের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করার তাওফিক দান করুন। সমাজে সুন্দর অবস্থান তৈরি করে দেওয়ার তাওফিক দান করুন। এ কাজ সম্পাদনে আল্লাহ তাআলা সবাইকে কবুল করুন। আমিন।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।