জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের মনে আশার সঞ্চার ঘটলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ক্রমশই আবেদন হারাচ্ছে রাজনৈতিক এ জোট- এমন ইঙ্গিত মিলছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানিতে। শুক্রবারের ওই কর্মসূচি সফল করতে সরকারবিরোধী প্রার্থীদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও খোদ জোটের প্রধান শরিক বিএনপিরই অনেক সিনিয়র নেতা তাতে সাড়া দেননি। ফ্রন্টের মিত্র ২০ দলীয় জোটের ছিলেন মাত্র তিনজন। এর বাইরে বাম জোটের কেউই আসেননি। সব মিলিয়ে ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানি কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন ধানের শীষের শতাধিক প্রার্থী।
কর্মসূচিতে যারাও এসেছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঐক্যফ্রন্টের নীতিনির্ধারকদের দাঁড় করিয়েছেন কাঠগড়ায়। নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের ব্যর্থতা নিয়ে কুমিল্লা-১০ আসনের ধানের শীষের প্রার্থী ও বিএনপিপ্রধানের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, ‘৫২ বছর ধরে রাজনীতি করছি, কখনও জেল খাটিনি। এ নির্বাচনের সময় প্রথম জেল খাটতে হয়েছে। সদ্য জেল থেকে বের হয়েছি। দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, আমাদের প্রতি জনসমর্থন ছিল শতভাগ। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা কিছুই করতে পারেননি। কেন পারেননি- তা জানা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যর্থতার জন্য আরেকটি গণশুনানি বা সমাবেশ দরকার। আমি মহাসচিব মির্জা ফখরুল, ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম আবদুর রব, মোস্তফা মোহসীন মন্টুর কাছে জানতে চাই, কেন পারলাম না কিছু করতে? এ বিষয়ে জবাবদিহিতা দরকার বলে মনে করি। কেন্দ্রীয় নেতারা কেন পারলেন না- তা জানার জন্য একটি সমাবেশ দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির যুগ্ম মহাসচিবরা যদি খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সমাবেশ চান, যারা প্রোগ্রাম দেবেন তারাও যদি বলেন প্রোগ্রাম দেন, তাহলে প্রোগ্রাম দেবেন কে? বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া যদি কিছুই করা সম্ভব না হয়, তাহলে আর কিছু না করে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যবস্থা করুন।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, লে. জে. (অব) মাহবুবুর রহমানদের দেখা যায়নি ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচিতে।গণশুনানিতে না থাকার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন শুক্রবার রাতে বলেন, ‘আমি একটা বিয়েতে ব্যস্ত আছি।’ তবে দলের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিএনপি নেতাদের আগ্রহ কমেছে। নির্বাচনের দুই মাস হতে চললেও জোটের পক্ষ থেকে কাঙ্ক্ষিত কর্মসূচি না থাকায় অনেকেই ঐক্যফ্রন্টকে এড়িয়ে চলছেন। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ নেতার মতের বাইরে গিয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করায় তারা রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
এদিকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে গণশুনানিতে থাকতে পারেননি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক। তবে আমন্ত্রণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা-১৭ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী ও ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ। তিনি বলেন, ‘টেলিফোনে গণশুনানির আমন্ত্রণ পেয়েছি। কিন্তু কিসের ওপর গণশুনানি হবে, কার নেতৃত্বে গণশুনানি হবে, আমরা কিসের ওপর বক্তব্য দেব- এসব বিষয়ে কিছুই জানি না। এ নিয়ে ২০ দলীয় জোটের কোনো সভাও হয়নি। না জেনে না শুনে তো যাওয়া যায় না।’
‘চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গণশুনানি পিছিয়ে দেয়া যেত’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
লক্ষ্মীপুরের একটি আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হয়েছিলেন এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদৎ হোসেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচিতে দাওয়াত পেয়েছিলাম। কিন্তু তাদের গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। আমি মনে করি, ২০ দলীয় জোটকে আরও শক্তিশালী করা দরকার।’ গণশুনানি কতটুকু সফল হলো- জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘৩০ তারিখে নির্বাচন হয়েছে বলে সরকার যে দাবি করেছে, সেটা আসলে কোনো নির্বাচনই ছিল না। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্ট অথবা ২০ দল। নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন সেটাই বর্ণনা করা হয়েছে গণশুনানিতে। এটা মিডিয়ার মাধ্যমে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে যাবে। এখানে সফল অথবা ব্যর্থতার অবকাশ নেই। এটা একটা জাতীয় লজ্জা।’
দলের সিনিয়র নেতাদের গণশুনানিতে অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা হয়তো নানা কাজে ব্যস্ত রয়েছেন, এ কারণে আসতে পারেননি। এখানে মুখ্য হচ্ছে পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল।’ এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের যারা ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন, গণশুনানিতে আসতে তাদের আহ্বান জানানো হয়। তাতে ৭০ থেকে ৭২ জন অনুপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থীদের নামে মামলা আছে, এছাড়া কারও না কারও অন্যান্য সিডিউলও থাকে। এটা নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’
‘তবে, আমি মনে করি উপস্থিতির হার ছিল অনেক। সিনিয়রদের মধ্যে ড. আব্দুল মঈন খান ছিলেন, মির্জা আলমগীর তো দলেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আব্দুল্লাহ আল নোমানকেও দেখেছি। মির্জা আব্বাস তো অসুস্থ। মওদুদ ভাই, মোশাররফ স্যার বা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কেন আসলেন না এগুলো এখন বিশ্লেষণের সময় নয়। এখন কথা একটাই, সবাই মিলে বেগম জিয়াকে আগে মুক্ত করতে হবে। এখন সমালোচনার সময় নেই, যেহেতু আমরা বিপদগ্রস্ত।’ চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গণশুনানি পেছান যেত বলে আন্দালিভ রহমান পার্থের মন্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ফারুক বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা শোক প্রস্তাব করেছি এবং নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছি।’
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।