রোজগার্ডেন থেকে গণভবন। ভাড়া বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সুরম্য ১০ তলা কেন্দ্রীয় কার্যালয়। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের দমন-পীড়ন থেকে পরপর তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতা। ভাষার অধিকার আদায় থেকে ভাতের অধিকার নিশ্চিত করা।
সুদীর্ঘ সাত দশকে স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব, সংবিধান প্রণয়ন, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব, কোভিড বিশ্বেও উন্নয়নের রোল মডেল, মেট্রোরেল থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল- উন্নয়নের মহাযজ্ঞের নেতৃত্বের নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
জাতীয়তাবাদ (বাঙালি), গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার তারকাখচিত চার মূলনীতি নিয়ে ৭২ বছরে পথচলা। চড়াই-উতরাইয়ের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ‘নৌকা’ প্রতীকে মিশে আছে সংগ্রাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর আকাশছোঁয়া সাফল্যের গৌরবগাথা। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের শক্তির মিশেলে আজো অপ্রতিরোধ্য আওয়ামী লীগ।
জাতির পিতা থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা- উন্নয়নের মহাসড়কে বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণের। দুর্নীতি, মাদক, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্বপ্নপূরণে এগিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ-এমন প্রত্যাশা বিশ্লেষকদের।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদের রোজ গার্ডেনে আড়াইশ-তিনশ লোকের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’
সভাপতি মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আর ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
সাফল্য হিমালয়সম: প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালি চেতনার ধারক-বাহক হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষানীতি, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ষেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের মানুষকে সংগঠিত করেছে আওয়ামী লীগ।
পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রামের পরিণতি পায় মহান একাত্তরে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয় লাল-সবুজের পতাকা ও বাংলাদেশের মানচিত্র। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সব অর্জন ও সমৃদ্ধির ইতিহাসের পাতার পরতে পরতে একটিই নাম আওয়ামী লীগ।
বিভিন্ন সময় সরকারি দলের দমন-পীড়ন, ইতিহাসের নির্মম হত্যাকাণ্ড বঙ্গবন্ধু হত্যা, কলঙ্কজনক জেল হত্যাকাণ্ডসহ কঠিন চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে ৭২ বছরের আওয়ামী লীগকে বর্তমান অবস্থানে আনতে পিতা-কন্যার অবদানই সর্বোচ্চ। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে সংবিধান প্রণয়ন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত শূন্য অর্থনীতিকে চাঙা করে তোলেন।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ঘাতকের বুলেটে বাস্তবে রূপান্তর করতে পারেননি। বর্তমানে পিতার স্বপ্ন পূরণ করছেন তার কন্যা। ডিজিটাল বাংলাদেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলের মধ্য দিয়ে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন সফল করে চলেছেন।
ধর্মান্ধ পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উন্মেষ ঘটিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রথম সফলতা, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদ, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের অতুলনীয় ভ‚মিকা ছিল।
তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণের প্রত্যাশাকে প্রতিনিধিত্ব করেছে দলটি। আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রতিনিধিত্ব করে জনগণের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছে। ভাষা ও সাংস্কৃতিকভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গঠন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন তিনি।
পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ : জাতিকে স্বপ্ন দেখানো আওয়ামী লীগের ওপর মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। দলটির সামনে চ্যালেঞ্জও পাহাড়সম। একদিকে দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের কঠিন চ্যালেঞ্জ অন্যদিকে অসমাপ্ত বিশেষ প্রকল্পের কাজ ঠিক সময়ে শেষ করার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জন্মলগ্ন থেকেই কাকরবিছানো পথে হাঁটছে আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রীয় মদতে বারবার আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চলেছে। যে বুলেটে প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর, সেই বুলেট আজো তাড়া করে ফিরছে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে। তবুও পিতার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে চলেছেন আলো হাতে আঁধারের যাত্রী।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বলেন, পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকারের দুঃশাসন, নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের জন্ম। আর জন্মলগ্ন থেকেই গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে কাজ করছে আওয়ামী লীগ।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরেই কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের মহাসড়কে। মাতৃভাষা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা, সমুদ্রসীমা জয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান, স্যাটেলাইটের নিজস্ব মালিকানা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূরীকরণসহ সুদূরপ্রসারী সাহসী নেতৃত্বদানে বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকজন রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে শেখ হাসিনা আজ অন্যতম।
অনেক বাধা অতিক্রম করে সাধারণ জনগণের ভালোবাসায় অত্যন্ত দক্ষতা, সততা ও সফলতার সঙ্গে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। আগামী দিনের পথচলায় জনগণকে আওয়ামী লীগের পাশে থাকার আহ্বানে জানান আমু।
হিমালয়সম অর্জন সত্ত্বেও চার মূলনীতি সমুন্নত রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণকেই আগামী দিনে আওয়ামী লীগের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, বিভিন্ন সময় প্রচণ্ড দমননীতির মধ্যে টিকে আছে দলটি। ’
৭৫ এরপরও টিকে ছিল, আজো আছে। নিপীড়ন সত্ত্বেও স্বাধীনতার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব, সংবিধান উপহার, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে সফল আওয়ামী লীগ। গত এক দশকে আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত। আকর্ষণীয় গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছে দেশ। বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র বাংলাদেশের নাম অবধারিতভাবে আলোচিত হচ্ছে। কোভিড বিশ্বেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
আগামী দিনে আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও সমাজে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করাই বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন দেখানো। এই ক্ষেত্রগুলোতে দলের কর্মকাণ্ড যথাযথ মাত্রায় দেখা যাচ্ছে না। প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের প্রতিটি শক্তিকে নিয়ে একসঙ্গে পথচলা। দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখা। পয়সাওলাদের তোষণ ও পোষণ আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও এসব ক্ষেত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন আসছে। ব্যাপক আকারে পরিবর্তন প্রয়োজন।
অবশ্য এসব চ্যালেঞ্জকে বড় করে দেখছে না আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, লড়াই করেই এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। জানতে চাইলে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন।
আর দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। মাদক-জঙ্গিবাদ-মৌলবাদসহ সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত আওয়ামী লীগ।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।