হাসিনার হস্তান্তর: ঢাকা যদি চায়, দিল্লি ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত

নিজস্ব প্রতিবেদক
সৌম্যা সাহা , কলকাতা প্রতিনিধি ভারত
প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:১৭ অপরাহ্ন
হাসিনার হস্তান্তর: ঢাকা যদি চায়, দিল্লি ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবির তীব্রতা বাড়ছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে ভারতেই অবস্থান করছেন তিনি, এবং এ অবস্থায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রধান প্রসিকিউটর জানিয়েছেন যে, শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এই ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর ফলে, দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিটি একটি নির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে।



শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দেড় শতাধিক মামলা রয়েছে, যার মধ্যে হত্যা, নির্যাতন ও গুমের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। বিশেষ করে, ২০১১ সালে বদরপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর সহিদুল ইসলাম মৃধা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এসব অভিযোগের কারণে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলো তাঁর দেশে ফেরার বিষয়ে দৃঢ় মত প্রকাশ করছে।



ভারতের আইন অনুযায়ী, শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য দুইটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি কাঠামো রয়েছে: ১৯৬২ সালের প্রত্যর্পণ আইন এবং ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি। চুক্তির ১ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, শুধু সেই ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণ করা হবে যারা অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তবে, অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে, কারণ মামলাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনও প্রমাণিত হয়নি।



ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিযোগ থাকে, তাহলে তাদের প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে, তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে অভিযোগগুলো নিপীড়নমূলক হতে পারে, যা আইনগতভাবে তাঁকে প্রত্যর্পণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য নয়।


এছাড়া, চুক্তির ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতে বিচার চলমান হয়, তাহলে প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনও বিচার চলমান নেই, তাই এই ধারা তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।


ভারত সরকারের সামনে এখন আরেকটি বিকল্প রয়েছে, সেটি হচ্ছে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তবে, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ভারতের কৌশলগত স্বার্থ ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় ভারতের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকতা রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্ত নেবে কি না। রাজনৈতিক বাস্তবতা ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলি বিচার-বিশ্লেষণের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যদি ভারত তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে তাঁকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ এনে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।


আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, ভারতকে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে যা কেবল আইনি দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্তও হবে। সরকারের প্রতি চাপ ও দেশে ফিরিয়ে আনার দাবির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।



শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্নটি এখন আইনি সমস্যা ছাড়িয়ে রাজনৈতিক পরিসরে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতের সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র আইনি দিক থেকে নয়, বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। ভারত যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুক, তার কার্যকারিতা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতির ভাষা ব্যবহার করতে হবে। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।