সামি মাহমুদের গল্প "একজন বড় ছেলে"

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সোমবার ২২শে জুন ২০২০ ০২:২৪ অপরাহ্ন
সামি মাহমুদের গল্প "একজন বড় ছেলে"

আমি একজন বড় ছেলে। নাটকের সঙ্গে আমার জীবনের আহামরি তফাত নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা যেমন পাবলিকে চান্স পায়, আমিও পেয়েছি। মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কিন্তু, তথাকথিত সুন্দর পৃথিবীর অসুন্দর দিকটার  প্রায় অনেকখানিই দেখা হয়ে গেছে। আমাকে ভাবতে হয়, " ছোটবোনটার জন্য আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। বাবা মা-কে খুশি করার জন্য আমাকে লড়তে হবে।

আমার অগ্রগামী ভবিষ্যতকে যেন আমার মত কষ্ট করতে না হয়, তার জন্য লড়তে হবে। কারণ, আমি তো বড় ছেলে!"মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি নতান্তই অত্যাচারিত,  অবহেলিত একজন মানুষ। হয়ত কেউ বিশ্বাসই করবে না, এই মানুষটার কখনও কোন স্বপ্নই বাস্তবায়িত হয়নি। সবাই, এক কথায় সব্বাই এই মানুষটাকে ব্যবহার করে। 

আমার বয়সী ছেলেরা কি করে!!? 

ভালো স্মার্টফোন চালায়, ভালো জামা কাপড় পড়ে, উইকেন্ডে ঘুরতে যায়, মোটা পকেটমানি পায়!! আর আমি, আমিও স্মার্টফোন চালাই। তবে সেটার উপর বাংলাদেশ আঁকা আছে। আজ ১ বছর হল৷ বদলানো হয়নি। আমিও জামা কাপড় পড়ি, আশ্চর্য!! আমি কি নেংটো থাকব নাকি!! তবে আমার জামা কাপড় সংখ্যা সীমিত।  ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে পড়তে হয়! আর উইকেন্ড, সস্তায় সপ্তাহের ৬ দিন টিউশন করানো ছেলেটা উইকেন্ডে মৃতপ্রায় কুকুরের মত শুয়ে থাকতে চায়, কিন্তু সে পারেনা। তাকে প্রস্তুতি নিতে হয়। কোন পার্ট টাইম জবের জন্য, কিংবা কোন ভালো কোচিং সেন্টারে চাকরী পাবার জন্য!!

আমি লেখালেখিও করি,কদাচিৎ । ক্লাসের সেই সুকণ্ঠিকে ভেবে ভেবে পৃষ্ঠা দু'য়েক লিখে ফেলি! কিন্তু কখনও দেয়া হয়না। ভয়, সংকোচ! কারণ, আমার ভালো লাগা কোন কিছুই যে আজ পর্যন্ত আমার হয়নি!! সবাই শুধু আফসোস করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিত্তশালী ব্যক্তিরও আফসোস আছে।আমার শিক্ষিকা মা আমায় হর-রোজই মনে করিয়ে দেয়, "বাবা!  অনেক স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিস। ঠিকমত পড়! নয়ত কিচ্ছু করতে পারবি না জীবনে। " 

আমার তখন হাসি পায়! আম্মুকে কখনও বলাই হয়নি যে " আম্মু! আমি না আর সপ্ন দেখি না। আমি শুধু আকাশ দেখি। আর ভাবি আমাকে আকাশের মত হতে হবে। আমার বুকে সবাই ঠাঁই পাবে! কিন্তু আমি কারো বুকে ঠাঁই পাবোনা। "আমাকে মা মনে করিয়ে দেয়! বাড়িতে এবার ঘর করা দরকার!!এবার পাঠক হয়ত ভাবছেন আমার কি বাবা নেই! জ্বী,  আছেন! আমার লেখালেখির শুরুটা বাবার লেখা ডায়রিটা পড়েই শুরু হয়েছে।

বাবাও সারাটা জীবন খেটেছেন। ভালো কামিয়েও ছিলেন। কিন্তু, তাঁর স্বর্ণযুগটা তিনি তার বিশাল ফ্যামিলির জন্যই খরচ করেছেন! নিজেকে আকাশের মত বানিয়েছিলেন! শেষমেশ দেখেন, তার জন্য আর কারও বুকে ঠাঁই নেই।আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এবার মোবাইলটা বদলাবো। তখন আবার মায়ের ফোন আসে। মা আমায় অনেক কিছুই মনে করিয়ে দেয়! আমার আবার মনে পড়ে,  সামনে তো ঈদ! ছোটবোনটার জন্য কিছু লাগবে। জমানো টাকাটা খরচ করার আর সাহস হয় না।

আসলে, অনেকে ভাবে যে যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই হয়! কিংবা কাশ্মিরে কিংবা আফ্রিকায়।তারা তো জানেনা,  এ পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ একেকজন যোদ্ধা। বিশ্বাস হয়না??! পাবলিকে গিয়ে একজন বড় ছেলের চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখবেন! না কামানো দাঁড়িগুলোর দিকে! লাল হয়ে থাকা চোখের দিকে! দেখবেন, চোখজোড়া আকাশে তাকিয়ে আছে! সেই চোখে শুধু হাহাকার! না পাওয়ার বেদনা। সেই ছেলেটা কাতর চোখে ক্লাসের সুকণ্ঠির দিকে তাকিয়ে থাকে! তার চোখে রাজ্যের জিজ্ঞাসা! সে ক্যাণ্টিনে গিয়ে ভাবে, ৩৫ না ৩০??? শেষমেশ সে ১০ টাকার বিস্কিটেই লাঞ্চ সারে। 

প্রফেশনাল যোদ্ধারা অস্ত্র নিয়ে লড়াই করে৷ আর আমরা!? আমাদের হাত দু'টোই  আমাদের অস্ত্র। আমাদের পা দু'টো হচ্ছে ধাবমান ঘোড়া। আমাদের ফ্যাকাসে চোখ দু'টো হচ্ছে দূরবীন। যতদূর চোখ যায় আমরা জয় করতে চাই! আর আমাদের মনটা হচ্ছে একেকটা আকাশ। আমরা পুরো পৃথিবীকেই ঠাঁই দিতে চাই। আমাদের বুক কেটে কেউ যদি দেখতে পেত! ভেতরটা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে আছে। অভিযোগ আর অভিযোগ! এত অভিযোগ সমগ্র পৃথিবীর পুলিশ স্টেশানে লিখে ঠাঁই দেয়া যাবেনা। এটা একজন বড় ছেলের জীবন। মধ্যবিত্ত একজন বড় ছেলের জীবন।

শিক্ষার্থী
বাংলা বিভাগ,জবি