মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নৃশংসতা চালিয়েই যাচ্ছে। এ নৃশংসতা বন্ধ করার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বুধবার (২৩ অক্টোবর) অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক নতুন প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির বিভিন্ন স্থানে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভিত্তিতে জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নতুন করে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে গ্রেফতার, আটক ও নির্যাতনের শিকার হওয়া জাতিগত কাচিন, লিসু, শান, তা'আং ও রোহিঙ্গা মুসলিমের কথা বলা হয়েছে।
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক নিকোলাস বেকুয়েলিন বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী অপরাধ প্রবণতা থেকেই বেসামরিক লোকদের ওপর আগের মতো নিষ্ঠুর ও নির্মম অত্যাচার করছে। যা যুদ্ধাপরাধের শামিল। দেশটিতে জবাবদিহিতা না থাকায় সেনাবাহিনীকে সামরিক বাহিনীর নির্মমতার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের আবাস ছাড়াও মূলত বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান কাচিন ও শান রাজ্যেও কয়েক দশক ধরে অভ্যন্তরীণ বিরোধ লেগে রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বুধবার (২৩ অক্টোবর) বাকুতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের ভূমিকার বিষয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গা সংকটের দোষীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি। অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও মিয়ানমার এ পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়নি বলে জানান তিনি। এর একদিন আগেই ২২ অক্টোবর মিয়ানমার সরকার বলেছে, ২৯ জন রোহিঙ্গা মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় ফিরে গেছে। তারও আগে ঢাকাস্থ মিয়ানমার দূতাবাস জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ৩৫১ জন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ফিরে গেছে।
একদিকে মিয়ানমার বলছে, রোহিঙ্গা মুসলিমরা নিজ দেশে ফিরে আসছে, অন্যদিকে সেনাবাহিনী তাদের আটক করে পুলিশে দিচ্ছে। রাখাইন রাজ্য থেকে ইয়াঙ্গুন শহরে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে সেপ্টেম্বরে ৩০ জন রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুকে আটক করা হয়। মিয়ানমারের নাগরিক রেজিস্ট্রেশন আইনের অধীনে মোট ২১ রোহিঙ্গাকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে বলা হয়েছে যে নাগরিকদের তাদের পরিচয় প্রমাণের জন্য অবশ্যই ‘রেজিস্ট্রেশন কার্ড’ রাখতে হবে। এ আইনটি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে, যারা এ দেশের নাগরিকত্ব বঞ্চিত এবং সরকারিভাবে রাষ্ট্রহীন। এ দলে থাকা নয় শিশুকে কিশোর আটক কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল। যেসব রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ফিরে গেছে বলে মিয়ানমার দাবি করেছে, তারা নিজ বসতিতে ফিরে গেছে নাকি বন্দিশিবিরে রয়েছে, তা জানা যায়নি।
এদিকে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মিসহ (কেআইএ) কাচিন বিদ্রোহীরা ১৯৬২ সাল থেকে আরো বেশি স্বায়ত্তশাসনের জন্য মিয়ানমার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের মার্চের একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। ঘটনাটি হলো-শান রাজ্যের কুটকাই টাউনশিপে মাছ শিকার করে আসা দুই কাচিন গ্রামবাসীকে সেনারা আটক ও নির্যাতন করেছিল। তাদের একজনের বয়ান, একজন সৈনিক জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি কেআইএ? আমি বললাম না। তখন তারা আমাকে ঘুষি এবং লাথি মারতে শুরু করে। তারা আমার জামা খুলে ফেলতে বাধ্য করে। আমার গলায় একটি ছুরি ধরে। তারপর তারা আমাকে আমার আঙ্গুলগুলো আমার হাঁটুর নিচে রাখতে বাধ্য করলেন...। তারা আমাকে বলল যে আমি যদি হাত সরাই তাহলে আঙ্গুলগুলো কেটে ফেলবে...। তারা আমার মুখে একটি গ্রেনেড রেখেছিল..., আমি ভয় পাচ্ছিলাম, হাত সরিয়ে ফেললে সেটি যদি বিস্ফোরিত হয়।
ভুক্তভোগীরা অ্যামনেস্টিকে জানিয়েছে যে সামরিক বাহিনীর কুখ্যাত ৯৯তম হালকা পদাতিক বাহিনী এ ধরনের বহু মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত। বিদ্রোহ দমনে নির্মমতার জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছে বাহিনীটি এবং এদের অত্যাচারেই সীমান্ত পেরিয়ে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এতে প্রমাণ হয়, এমন কিছু ভয়াবহ অত্যাচারে তারা জড়িত ছিল, যার জন্য এত মানুষ পালিয়ে শরণার্থী শিবিরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিবেদনে জাতিগত সশস্ত্র দলগুলোর বিরুদ্ধে অপহরণ ও জোরপূর্বক কাজ করানোসহ জঘন্য দুর্ব্যবহারেরও অভিযোগ করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় গৃহযুদ্ধের সময় গ্রামগুলোর হাজার হাজার বেসামরিক লোক বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
ইনিউজ ৭১/এম.আর
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।