অজানা আতঙ্কে দখিণের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
এম. কে. রানা - বার্তা প্রধান ইনিউজ৭১
প্রকাশিত: সোমবার ১৫ই এপ্রিল ২০১৯ ০৮:১৬ অপরাহ্ন
অজানা আতঙ্কে দখিণের কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা

সম্প্রতি বরগুনায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় এক শিশু শিক্ষার্থী নিহত এবং ১০ শিক্ষার্থী আহত হওয়ার কারণে দখিনের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রয়েছে অজানা আতঙ্কে। আর অভিভাবকরা তাদের প্রিয় সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে থাকেন উদ্বীগ্ন। এছাড়া অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেয়ায় বিভাগের অনেক স্কুলেই উপস্থিতি সংখ্যা কমে গেছে। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার জানালেও কোন সুফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকরা। 

জানা গেছে, বরগুনার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের ছাদ ভেঙ্গে এক শিশুর করুণ মৃত্যু ও অনেকে আহত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সারাদেশে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবন চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। গত সোমবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এক আদেশে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনগুলো চিহ্নিত করে আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয়কে জানাতে সব জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণে শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রয়োজনে উপজেলা প্রকৌশলী এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সহযোগিতা নিতে পারবেন বলেও আদেশে বলা হয়। 

অগ্নিকান্ড, ধর্ষণ, ভবন ধসে মৃত্যু কিংবা বড় ধরণের কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই কেবল আমাদের দেশের দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিদের টনক নড়ে। ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই তদন্ত আলোর মুখ দেখে না। সম্প্রতি ঢাকায় বহুতল ভবনে অগ্নিকান্ডে বহু হতাহত, বরিশালের বরগুনায় স্কুলের ছাদ ধসে শিশুর মৃত্যু, নরপিশাচ সিরাজউদ্দোলার লালশার শিকার না হওয়ায় আগুন দিয়ে নুসরাতের শরীর ঝলসে দেয়ায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিয়েছে নুসরাত। এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরই কেবল টনক নড়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের অবহেলায় যেই অবস্থা সেই অবস্থাতেই থেকে যায়। 

সূত্রে জানা যায়, বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলায় প্রায় সহগ্রাধিক বিদ্যালয়ের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় ২৭৩টি, পটুয়াখালী জেলার ৭টি উপজেলায় ১ হাজার ২২৫টি, পিরোজপুরে ৯৩টি, ঝালকাঠিতে শতাধিক, বরগুনায় ১৫১টি ও ভোলায় ১২০টি বিদ্যালয়ের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া এসব জেলার শতাধিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভবনকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ভবনগুলোর ছাদ ও পিলারের পলেস্তারা খসে ও রড বেরিয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনা আতঙ্কে রয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। 

বরিশাল সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, এ উপজেলায় ৪৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন আছে বাবুগঞ্জে ৯টি, বানারীপাড়ায় ৫টি, আগৈলঝাড়ায় ২৩টি ও বাকরগঞ্জে ৫০টি। পটুয়াখালী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছাইয়াদুজ্জামান বলেন, পটুয়াখালী জেলার ৭টি উপজেলায় ১২২৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্য অন্তত ২৭২টি ঝুঁকিপূর্ণ। জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান না করানোর জন্য সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও নতুন করে বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এসেছে। ১৫ দিনের মধ্যে তালিকা তৈরি করে মন্ত্রনালয়ে পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়ের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।

উজিরপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলার ২২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। মুলাদীর ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আরিফ খান। গৌরনদী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ফয়সাল খান জানান, এ উপজেলায় ৪০টি বিদ্যালয় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। পিরোজপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সূত্র মতে, কাউখালী উপজেলায় ১৫টি বিদ্যালয় রয়েছে যেগুলো টিনশেড কাঁচাঘর, টিনশেড আধাপাকা ঘর ও পুরাতন ভবন। নাজিরপুর উপজেলায় ২৫টি জরাজীর্ণ ভবন, সদরে তিনটি পরিত্যক্ত ও চারটি জরাজীর্ণ, ভান্ডারিয়া উপজেলায় ১৮টি জরাজীর্ণ, মঠবাড়িয়া উপজেলায় ১৫টি বিদ্যালয় রয়েছে যেগুলোর ছাদ, দেয়াল, দরজা জানালা ও মেঝে নষ্ট। স্বরূপকাঠি উপজেলায় ১৯টি বিদ্যালয় জরাজীর্ণ, মঠবাড়িয়া উপজেলায় ১৫টি জরাজীর্ণ এবং ইন্দুরকানিতে দুটি বিদ্যালয় পরিত্যক্ত এবং ১৮টি বিদ্যালয় জরাজীর্ণ রয়েছে।

বরগুনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, বরগুনা জেলায় ৭৯৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫১টি বিদ্যালয়ের ভবন জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়া বামনা উপজেলায় ৬২ বিদ্যালয়ের মধ্যে ৬টি ঝুঁকিপুর্ণ। পাথরঘাটা উপজেলায় ১৪৯টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪২টি বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে ২০টি বিদ্যালয় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। আমতলীতে ১৫২টির মধ্যে ৬টি ঝুঁকিপূর্ণ। তালতলীতে ৭৮টির মধ্যে ২৮টি বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ। জানা গেছে, ওই সব ভবন ১৯৯০ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে স্কুল ভবণ নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষকরা।

ঝালকাঠি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেই ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে মাথায় পড়ছে, কখনও পড়ছে বৃষ্টির পানি। জেলায় মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৯৩৭টি (কিন্ডার গার্টেন বাদে)। এর মধ্যে কলেজ ২৭টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৯৩টি, কারিগরি বিদ্যালয় ১০টি, কামিল মাদ্রাসা ০১টি, অন্যান্য মাদ্রাসা ১২২টি (কওমি বাদে) এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৮৪টি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।

উল্লেখ্য তালতলী উপজেলায় গত সপ্তাহে ছোট বগি পি.কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান চলাকালে ভবনের ছাদের নিরাপত্তা ভিমের পলেস্তারা ধসে পড়ে এক শিক্ষার্থী নিহত এবং নয়জন আহত হয়।

ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব