সেবা না বাড়িয়ে দুই বছরের ব্যবধানে আবারও বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেনের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এবার ২৫ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) চাপ এবং অন্য এক বিদেশি পরামর্শকের সুপারিশে লোকসান কমাতে রেলওয়ে প্রতিবছরই ট্রেনের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর জন্য কাঠামো নির্ধারণ করেছে। প্রতিবছর ভাড়া বাড়ানোর নীতি অনুসরণ করা শুরু হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে। তবে গত বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের রাজনীতির কারণে তা বাড়ানো হয়নি। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলে ভাড়া বাড়ানোর খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন গতকাল শনিবার বিকেলে বলেন, ‘এডিবির কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে আমরা রেলে যাত্রী ভাড়া সমন্বয় করব। রেলওয়ে প্রস্তাব তৈরি করেছে। তা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। আগামী জুনের মধ্যে তা কার্যকর করা হবে বলে আশা করছি।’
নতুন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন রেলওয়ের যাত্রীসেবার চিত্র দেখে নিজেই হতাশ। গত ৫ মার্চ কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রীসেবায় অব্যবস্থাপনা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এক মাসের আলটিমেটাম দিয়েছেন তিনি। গত কয়েক দিন কমলাপুর রেলস্টেশনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পরিস্থিতি বদলায়নি। ট্রেনের কোচে তেলাপোকা ও মশার উপদ্রব। আর সময়মতো ট্রেন ছাড়ে না। এসব অব্যবস্থাপনার মধ্যেই ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগের বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ট্রেন হলো গণপরিবহন। বিশেষ করে নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির যাত্রীরা বারবার ভাড়া বাড়ানোয় বিপদে পড়ে। এবার সুলভ শ্রেণির আসনের ভাড়াও বাড়ানো হবে—এটা দুঃখজনক।’ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, যাত্রীপ্রতি ন্যূনতম ভাড়া সুলভ শ্রেণির ক্ষেত্রে ৩৫ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ টাকা, শোভন শ্রেণির ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫৫, শোভন চেয়ারে ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৬৫, প্রথম শ্রেণির আসন নন-এসি ৯০ থেকে ১১০, স্নিগ্ধা (এসি চেয়ার) ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১২০, এসি আসন ও প্রথম শ্রেণির বার্থ (নন-এসি) ১১০ থেকে বাড়িয়ে ১৩০, এসি বার্থ ১৩০ থেকে বাড়িয়ে ১৬৫ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
২০ বছর পর ২০১২ সালের ১ অক্টোবর ট্রেনে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয় ৫০ শতাংশ। যাত্রী পরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে ভিত্তি ভাড়া ২৪ থেকে বাড়িয়ে তখন ৩৬ পয়সা করা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ৭.২৩ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়। তখন ভিত্তি ভাড়া ৩৬ থেকে বাড়িয়ে ৩৯ পয়সা করা হয়। প্রস্তাব থেকে জানা গেছে, ট্রেনে প্রতি কিলোমিটারে এখন ভিত্তি ভাড়া ১০ পয়সা বাড়িয়ে ৪৯ পয়সা করা হবে। খসড়া প্রস্তাব অনুযায়ী, বিভিন্ন আন্ত নগর ট্রেনে শোভন চেয়ার আসনে যাত্রীপ্রতি ভাড়া ২২ থেকে ৪৭ শতাংশ, এসি চেয়ার শ্রেণিতে ৩৯ থেকে ৬৪ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হবে। ঢাকা থেকে সবচেয়ে বেশি ট্রেন চলে চট্টগ্রাম রেলপথে। এই রেলপথে বর্তমানে আন্ত নগর ট্রেনে শোভন চেয়ার শ্রেণির ভাড়া ৩৪৫ টাকা। সেটি ৩৫ শতাংশ বাড়িয়ে করা হবে ৪৬৫ টাকা। এসি চেয়ারে ভাড়া ৬৩ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার ৭০ টাকা করা হবে। এখন এই ভাড়া ৬৫৬ টাকা।
ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-লালমনিরহাট ও ঢাকা-খুলনা রেলপথে শোভন চেয়ার শ্রেণিতে যাত্রীপ্রতি ভাড়া এখন ৫০৫ টাকা। সেটি বাড়িয়ে ৬৩০ টাকা করা হবে। এ দুটি রেলপথের ট্রেনগুলোতে এসি চেয়ারে যাত্রীভাড়া ৯৬৬ টাকা। সেটি এক হাজার ৪৪৯ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকা-রাজশাহী রেলপথে শোভন চেয়ারে ভাড়া ৩৪০ থেকে ৪৬৫ টাকা করা হচ্ছে। আর এসি চেয়ারে ভাড়া ৬৫৬ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৭০ টাকা করা হবে। ঢাকা-সিলেট রেলপথে শোভন চেয়ারে ৩২০ থেকে ৪৩৫ টাকা এবং এসি চেয়ারে ৬১০ থেকে এক হাজার এক টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকা-দিনাজপুর রেলপথে শোভন চেয়ারে ভাড়া ৪৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৩০ টাকা এবং এসি চেয়ারে ৯৯০ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৩৮০ টাকা করা হচ্ছে। ঢাকা-পঞ্চগড় পথে শোভন চেয়ারে ৫৫০ থেকে বাড়িয়ে ৬৭৫ টাকা এবং এসি চেয়ারে এক হাজার ৫৩ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৫৫৩ টাকা ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
যাত্রীসেবা নেই: ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সুবর্ণ এক্সপ্রেসসহ বিশেষ কয়েকটি ট্রেনে অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধা থাকলেও পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে চলাচলকারী দুই শতাধিক ট্রেনে যাত্রীসেবার বদলে আছে হয়রানি। গত বৃহস্পতিবার সকালে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেল, কমলাপুর রেলস্টেশনের ভিআইপিদের অপেক্ষা কক্ষের সামনে মশা উড়ছে। টিকিট কাউন্টার থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ট্রলি নিয়ে যাত্রীদের বিরক্ত করছে কুলিরা। এসব ট্রলি বিনা মূল্যে ব্যবহারের জন্য। স্টেশনের বিভিন্ন জায়গায় ভাঙাচোরা ভ্যান, পুরনো আলমারি পড়ে আছে। টিকিট কাউন্টারে চলছে হয়রানি, ট্রেনের বগি অপরিষ্কার। আর সময়সূচির তো কোনো বালাই নেই। রাজশাহীর যাত্রী মো. এনামুল কবীর বলেন, ‘সিল্কসিটি ট্রেনে উঠব; কিন্তু মালামাল নেওয়ার ট্রলি নিয়ে আমার কাছ থেকে কুলিরা ১০০ টাকা নিয়ে গেল।’ কালনী ও উপবন ট্রেনে নিয়মিত সিলেট যাতায়াত করেন হাবিবুর রহমান। টিকিট কাউন্টারে গিয়ে টিকিট না পেয়ে ব্যবস্থাপকের কক্ষে যাচ্ছিলেন। বললেন, ‘কালনী ট্রেনে প্রথম শ্রেণিতেও তেলাপোকা ওড়ে।’ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক খন্দকার কোহিনুর আখতার ঊর্মি গত ৫ মার্চ সিলেট থেকে উপবন ট্রেনে ঢাকায় ফেরার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘অপরিষ্কার ও নোংরা পরিবেশে ট্রেনে চলতে হয়। তার পরও ভাড়া বাড়েই।’ সূত্র ঃ কালের কণ্ঠ
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।