১৫ই আগস্ট: ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সোমবার ১৪ই আগস্ট ২০২৩ ০৫:৪৫ অপরাহ্ন
১৫ই আগস্ট: ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত দিন

১৫ই আগস্ট। বাঙালি জাতির কলঙ্কময় দিনের এক চরম কালিমালিপ্ত অধ্যায়। এই দিনে আমরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের মধ্য হতে নিষ্ক্রান্ত করতে দেখেছি। বিমুঢ় এক জাতি বেদনায় বাকরুদ্ধ। আর হ্ন্তারক গোষ্ঠীকে তাবৎকালে তাদের চরম গ্লানির অচলায়তন ভেঙে উল্লাসে উল্লাসিত হয়ে জাতির চলমান প্রগতির চাকাকে উল্টে দেয়ার উন্মাদ উত্তেজনার অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে দেখলাম।


পরাধীনতার ধারক ও বাহক স্বৈরাচার গোষ্ঠী বিশ্বকে হতচকিত করে বাংলার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা স্বাধীনতার স্থপতিকে অমানবিক ক্রুর নিষ্ঠুরতায় হত্যা করল, একদল দেশি-বিদেশী চক্রান্তকারী আসুরিক শক্তির যোগসাজসে। বাঙালি জাতির হৃদয়কে রক্তের নির্দয় আখরে কলঙ্কিত করে ছিনিয়ে নিল আমাদের জাতির প্রাণ পুরুষকে। সদা হাস্যোজ্জল অমায়িক শিশুর অকপটতায় কাছে টেনে নেয়ার আত্মিক সৌন্দর্যে বিকশিত মানবতার প্রতীক ক্ষণজন্মা এই মহামানবকে নিশ্চিহ্ন করে দিল এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে। কিন্তু তার মৃত্যু তার কায়াকে আমাদের মাঝ থেকে কেড়ে নিলেও তার মৃত্যুহীন ছায়া আমাদের জন্য রেখে গেল এক অন্তহীন প্রাণ। মৃত্যুহীন প্রাণের সেই ছায়া খেটে খাওয়া মানুষের আস্থার পাদপিঠে নব জন্ম দিল মৃত্যুহীন এক মহামানব। মরণশীল শেখ মুজিব নবোতর উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলেন বিশ্ব মানবতার খেরো খাতায় মৃত্যুর ওপারে অনন্তকাল আস্থাশীল সাহসী পুরুষের প্রতীক হয়ে। সংযুক্ত হলেন সভ্যতার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মহামুনি মহাজনের কাতারে। জ্বলে উঠলেন অনন্য হয়ে। ৭ই মার্চের প্রস্তুতিহীন বক্তব্যের অনন্য নায়ক হয়ে বিশ্ব পরিধিতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তাদের অন্যতম শিরোপায় ভূষিত হলেন। তাই তো আমরা তর্পন করি তাকে অবিমিশ্র বেদনায়।


তার তিরোধানে জাতি হল সম্বিতহারা। বেদনাকাতর রক্ত ঝড়ানো বুকের কাপন তোলা অস্থির অমানিশার গভীর কালো মৃত্যু-গহ্বরে নিপতিত হল। অস্থির স্বত্তার নিকষ কালো অন্ধকার দিশেহারা জাতিকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো। সম্মুখে সীমাহীন ঝঞ্জাবিধ্বস্ত পাহাড় চূড়া থেকে ধেয়ে আসা অশান্তির বজ্র নিনাদ জাতিকে ধ্বংস করতে উদ্ধত ফনা তুলে দাঁড়িয়ে পড়লো। কান্ডারীহীন নৌকার দাড় তাই সেই অলক্ষুণে সময়ে কার হাতে তুলে দিতে পারতো বিভ্রান্ত সেই বাঙালি জাতি?


মুজিব হারানো দেশে সেদিন শকুনিরা পাখা মেলেছিল আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদি আত্মার ক্রন্দনকে বৃদ্ধাংগুষ্ট দেখিয়ে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে হরণ করার অপচেষ্টায়। বিজাতীয় অপশক্তিরা, আমাদের জন্মের উষালগ্ন থেকে যারা কোনদিন আমাদের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে চায়নি, তারাই সেদিন আমাদের অগ্রযাত্রাকে খামচে ধরার চেষ্টা করছিল। ঐ বিজাতীয় চক্রের কুশীলবরা চক্রান্ত করেছিল আমাদের জন্মের উষ্ণলগ্নকে গুঁড়িয়ে দিতে। মুক্তিযোদ্ধা লড়াকু বাঙালি জাতি তাদের সেই চক্রান্তকে গুড়িয়ে দিয়েছিল আপন মেধা-মনন আর পেশী শক্তির সম্মিলিত একতাবদ্ধ শক্তির জোরে। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে লড়াই করে। মৃত শেখ মুজিবের স্পন্দনহীন হৃদয়ের গভীর বেদনা, কান্না জর্জরিত জাতির হৃদয়ে নতুন আশার বাণী হয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন তিনি। কিংবদন্তির নায়ক হয়ে জাতিকে নতুন আশার বাণী শোনাতে। কিংবদন্তিরুপী নব মহামুনি হয়ে, জাতিকে নতুন আশার ভান্ডার খুলে নবজীবনের প্রত্যাশা অঙ্কুরিত করে। তাইতো মৃত শেখ মুজিব জীবনের জয় গান গাইতে জীবিত শেখ মুজিবের চাইতে বহুগুণ শক্তিশালী হয়েছেন। তখন গল্পের সীমানা ছাড়িয়ে স্বপ্ন হয়ে ওঠেন সেই মহামানব দেশ আর দেশের সামষ্টিক অগ্রগতির সমার্থক হয়ে। তখন বাংলাদেশ শেখ মুজিব আর বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা এক সূত্রে গাথা হয়ে যায়। তার স্বাধীন দেশের সৃষ্টি  সুখের উল্লাসে আকাশ-বাতাস, দিক-দিগন্ত দশ দিশা কাঁপিয়ে বিজয় ডঙ্কা বেজে ওঠে অলীক অবয়বে। নীল নব ঘন আকাশের নীল সাদা আর মেঘ মেদূর সোনালী সূর্যালোকের আলো জ্বালিয়ে বিস্মিত নয়নে চেয়ে দেখে-শোনে এক নবযুগের গান, “ওই মহামানব আসে বিজয় তূর্য নীনাদে উচ্চকিত ফুৎকার তুলে।” লক্ষ কন্ঠের সমন্বিত সুরে হাজার যোজন বিস্তৃত অসীমতা জুড়ে জেগে ওঠে স্বাধীন বাংলা সৃষ্টির গান, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।”


ইতিহাসের বর্ণনায় নির্যাতিত নিপীড়িত যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী ভিন জাতীয় শাসকের হাতে নিষ্পেষিত বাঙালি জাতির কষ্টের গাঁথা পেছনে ফেলে পৃথিবীর সামনে বুক উঁচু করে বেড়ে ওঠার, বিশ্বকে চমকে দেয়ার-এগিয়ে চলার আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতার নাম আজকের বাংলাদেশ। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ঋদ্ধ সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা, আর সাড়ে সাত কোটি মানুষের বুকের রক্তে আহরিত আপন ভূখন্ড বিশ্বে নন্দিত আজকের বাংলাদেশ। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের বিস্ময়।


এই বিস্ময় এই অভিজ্ঞতার- পথ চলার প্রতিটি ধূলিকণায় আঁকা শেখ মুজিবের নাম। ’৪৭ থেকে ’৭০-এ ২৩ বছরের প্রতিটি অভিজ্ঞতায় শেখ মুজিব বাঙালির জন্ম জন্মান্তরের সাথী। ’৭৫ এর ১৫ই আগস্ট অবধি এই জাতিকে গড়ে তোলার প্রতিটি চিন্তায় চেতনায় বিশ্বাসের গোঙায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির জনক হয়ে ওঠার এক বিস্ময়কর অনুরণন। এক প্রচন্ড বিস্ফোরণ।


এ প্রসঙ্গে ইতিহাস বেত্তারা অন্তহীন লেখনি চালিয়ে যেতে পারবেন। আমি সেই প্রসঙ্গে লেখার জন্য আজকে বসিনি। আমি বসেছি মৃত্যুহীন এই অভিব্যক্তির চিরন্তন হয়ে ওঠার কথা বলতে। বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ বংশধরদের- অনাগত প্রজন্মের পর প্রজন্মের শতবার- জাগতিক, আধ্যাত্মিক আর ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেষ্ঠত্বের অনুরণন শোনাতে।


বাঙালি জাতি আজ উন্নয়নের শোভাযাত্রায় বিশ্বনন্দিত। এককালে দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর সাইক্লোনে বিধ্বস্ত এক জাতির ছবি ছিল বাংলাদেশ। আপন প্রচেষ্টায় নিজ বাহুবলে নেতৃত্বের অনমনীয় দূরদর্শিতার কারণে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল তথা উন্নত দেশের কাতারে আগুয়ান। বিশ্ব তাকে সমীহ করে। তাই শেখ মুজিব আর শেখ হাসিনার সোনার বাংলা বিনির্মাণে এগিয়ে চলা জনপদের প্রতিচ্ছবি আজকের এই বাংলাদেশ। এ হচ্ছে উজ্জ্বল বাংলাদেশের সূর্যালোকে বিম্বিত মুদ্রার এপিঠের নাম।

মুদ্রার ও পিঠে আমরা কি দেখতে পাই?


বাংলাদেশ জনসংখ্যার আলোচনায় একটি তরুণ জনসমৃদ্ধ জনবসতির নাম। এদেশের মানুষগুলো কর্মঠ, ভাবনাশীল, কর্মোদ্দীপ্ত। খেটে খাওয়া মানুষের একটি বিশাল জগত এই বাংলাদেশ। কর্মের অভাবে কর্ম সক্ষম মানুষের একটি বিশাল অংশ অলস সময় কাটায়। রাস্তাঘাটে যানজটের কারণে একটা বিশাল কর্ম সময়ের অপচয় ঘটে। এদেশে কোটি কোটি মানুষ সরকারি অনুদানে সময় ক্ষেপণ করে। কর্মের নামে কর্মহীনতার নাটক করে। অবশ্য বিভিন্নভাবে প্রভাবশালী মানুষের একটা বিশাল অংশ লোভ লালসার শিকারি হয়ে প্রচুর অনার্জিত আয়ের স্বত্তভোগী। তাদের টাকার পাহাড় প্রায়শই জনগণের টাকায় সৃষ্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থার আনুকুল্য লাভ করেনা। এদের মধ্যে এক অংশের লোভ লালসা, পেশিশক্তি ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, অবৈধ দখলদারিত্ব, অর্থের অপব্যবহার অবর্ণনীয় আকার ধারণ করেছে। চরম দুর্নীতিপরায়নতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মহামারির পর্যায়ে চলে গেছে। তরুন সমাজে  মাদকদ্রব্যের বেচাকেনা, ব্যবহার, মাদকাসক্তি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ অবস্থার ঈঙ্গিত বহন করে। সমাজকে আপাদমস্তক দুর্বিতায়িত করে সমাজটাকে কলুষিত করার কাজে একদল পথভ্রষ্ট মানুষ গভীরভাবে নিয়োজিত আছে। এই গোষ্ঠীর রাশ টেনে ধরতে না পারলে সমাজের প্রগতি স্বপ্নই রয়ে যাবে। সমাজ ও সরকার পতিদের এখনই সময় এ সকল অগ্রহণযোগ্য কর্মকান্ডের ধ্বংস সাধনে উদ্যোগ গ্রহণ করার।


লেখক: -মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম (বীর মুক্তিযোদ্ধা), সাবেক সাধারণ সম্পাদক,  মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি।