শবে বরাতের ফজিলত ও করণীয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী- বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ
প্রকাশিত: বুধবার ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:২৫ পূর্বাহ্ন
শবে বরাতের ফজিলত ও করণীয়

শবে বরাত ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত, যা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে পালিত হয়। এই রাতকে কোরআনে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রাত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন হাদিসে বলা হয়েছে, এ রাতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ রহমতের দৃষ্টি দেন এবং অগণিত মানুষকে ক্ষমা করেন। তবে শর্ত হলো, মানুষকে সত্যিকারের অনুতপ্ত হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এ রাত সম্পর্কে ভ্রান্তি থাকলেও বিশুদ্ধ হাদিস ও কোরআনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সময়।  


রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শাবান মাসের মধ্য রাতে আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে এসে ডাকতে থাকেন, 'কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। কোনো রিজিক অন্বেষণকারী আছে কি? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব।' এভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা সুবহে সাদিক পর্যন্ত বান্দাদের ডাকতে থাকেন। তবে মুশরিক ও হিংসুক ব্যক্তিরা এ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়। এই হাদিসের সত্যতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত, এবং এটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।  


শবে বরাতে বিশেষ কিছু আমল করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘১৪ শাবানের রাতে নামাজ ও ইবাদতে রাত কাটাও এবং দিনে রোজা রাখো।’ সাহাবিরা এই রাতের বিশেষ গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বিভিন্ন হাদিস বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে উল্লেখ আছে, এক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) দীর্ঘ সময় সিজদায় থাকেন, যা দেখে আয়েশা (রা.) ভাবেন তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। পরে রাসুল (সা.) জানান, এটি শাবানের মধ্য রাত, যখন আল্লাহ বান্দাদের প্রতি বিশেষ দয়া বর্ষণ করেন।  


এই রাতকে 'বরকতময়' বলার অন্যতম কারণ হলো, এ রাতে ভাগ্য নির্ধারিত হয়। কিছু তাফসিরবিদের মতে, এই রাতেই মানুষের ভাগ্য সম্পর্কিত নানা বিষয় নির্ধারিত হয়, যেমন জন্ম, মৃত্যু ও জীবিকার হিসাব। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এ রাতে আল্লাহ পরবর্তী এক বছরের জন্য যাবতীয় ফয়সালা করেন। যদিও কিছু ইসলামি পণ্ডিত শবে বরাতের পরিবর্তে শবে কদরকে ভাগ্য নির্ধারণের রাত বলে মত দেন, তবে অনেক বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ শবে বরাতের বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন।  


শবে বরাতের অন্যতম সুন্নত আমল হলো ইবাদতে রাত কাটানো, বেশি বেশি তওবা করা, দরুদ পাঠ, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতে নামাজ আদায় করতেন এবং উম্মতকেও উৎসাহিত করতেন। এ রাতে ক্ষমা প্রার্থনা, রোগমুক্তির দোয়া, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ কামনা করা উচিত। এছাড়া, শবে বরাত উপলক্ষে কবর জিয়ারতের বিশেষ ফজিলতের কথাও বর্ণিত হয়েছে, কারণ রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও এ রাতে কবরস্থানে গিয়ে দোয়া করেছেন।  


তবে শবে বরাত উপলক্ষে অতি আনুষ্ঠানিকতা, আতশবাজি, আনন্দোৎসব বা কুসংস্কারমূলক কাজ ইসলাম সমর্থন করে না। অনেক মানুষ ভুল ধারণায় এই রাতে বিশেষ খাবার বিতরণ ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনকে ইবাদতের অংশ মনে করে, যা ইসলামের মূল শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং এ রাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের জন্য একনিষ্ঠভাবে ইবাদত করা।  


এ রাতের করণীয় সম্পর্কে আলেমরা বলেন, কেউ চাইলে নফল নামাজ আদায় করতে পারেন, তবে নির্দিষ্ট কোনো রাকাত সংখ্যা বাধ্যতামূলক নয়। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে নামাজ ও ইবাদত থেকে দূরে ছিলেন, তাঁদের জন্য এটি ফিরে আসার একটি সুবর্ণ সুযোগ। এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোরআন ও হাদিসের বিশুদ্ধ ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করাই শ্রেয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই পবিত্র রাতে যথাযথ ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।