পেছন ফিরে দেখলে ২০ বছর আগে নড়াইল থেকে ঢাকায় আসা কিশোরের দীর্ঘ ক্রিকেট ভ্রমণ কতটা রোমাঞ্চকর মনে হয়?
মাশরাফি বিন মর্তুজা: প্রতিটি পদক্ষেপেই আনন্দ যেমন ছিল, তেমনি দুঃখও। তবে কষ্ট করে কোনো কিছু অর্জন করতে পারার মজাই আলাদা। ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে ভালোই লাগে। এত দিন ধরে যে জায়গাটায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, সেখানে কিছুটা হলেও বোধ হয় পেরেছি।
প্রশ্ন: এই সময়ে আসা সবচেয়ে দুঃখজনক মুহ‚র্ত কোনটি?
মাশরাফি: এত কঠিন কঠিন সময়ে ইনজুরিতে পড়েছি, যখন আমি খুব ভালো ফর্মে ছিলাম। টেস্ট ক্রিকেটে যখন সবে ভালো করতে শুরু করেছিলাম, তখনই। ২০১১-র বিশ্বকাপ খেলতে না পারা, এটিও একটি।
প্রশ্ন : বেশ কয়েকবারই আপনাকে বলতে শুনেছি, ২০১১-র বিশ্বকাপ না খেলার দুঃখ বিশ্বকাপ জিতলেও যাবে না। এখনো সেই অবস্থানে আছেন অনড়?
মাশরাফি: দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলার অনুমতি না পাওয়া, ওই সময়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অনেক বড় ব্যাপারই। কিন্তু এসব নিয়ে পড়ে থাকলে তো সামনে এগোনো যায় না। তবে খারাপ লাগার কথা যদি বলেন, আমি এখনো সেই জায়গায় আছি। এমন নয় যে ভাবলে খারাপ লাগে না। সমস্যা হলো, ওটা নিয়ে পড়ে থাকলে তো আর জীবন চলবে না।
প্রশ্ন: ২০১৫-র বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত মুস্তাফিজের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা বোলার আপনি। যদিও আপনার নেতৃত্বের তুলনায় পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনাটা কমই হয়।
মাশরাফি: আমার তাতে সমস্যা নেই। শেষ পর্যন্ত দল ফল পেল কি না, সেটিই গুরুত্বপ‚র্ণ। আমার কাছে অন্য আর কিছুই নয়। আমার পারফরম্যান্স হয়তো আড়ালে থাকলেই ভালো। এমনিতেও আলোচনা কম হয় না। আলোচনা-সমালোচনা দিয়েই সব চলে। এত মিলিয়েও দেখি না। মেলাতে চাইও না
প্রশ্ন: এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কোন কোন দলকে হারাতে পারে?
মাশরাফি: বলা কঠিন।
প্রশ্ন: চার সেমিফাইনালিস্টের নাম নিশ্চয়ই বলতে পারবেন?
মাশরাফি: ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। সেই সঙ্গে অবশ্যই আমরা। এটা তো বলতেই হবে।
প্রশ্ন: আপনার টার্নিং পয়েন্ট?
মাশরাফি: অনেক আছে। একেক সময় একেকটি। ২০০১ সালে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে ভারত সফর এর একটি। সেখানে ভালো করাতেই আমার জন্য প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের দরজা খুলে গিয়েছিল।
প্রশ্ন: আপনার সিক্রেট?
মাশরাফি: সাঁতরে নদী পার হওয়া থেকে শুরু করে গাছে চড়া—এ রকম অনেক কিছুই আছে। খুব আড্ডাপ্রিয় মানুষ আমি। আড্ডায় বসলে এক নিমেষেই পার হয়ে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
প্রশ্ন: আপনার সেরা ম্যাচ?
মাশরাফি: বাংলাদেশ ক্রিকেটের একেক সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি ম্যাচের কথাই বলতে পারব। তবে আমাকে যদি এর মধ্যে একটি ম্যাচ বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে আমি বলব ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো ম্যাচটির কথা। ত্রিনিদাদে আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচও হয়েছিলাম।
প্রশ্ন: আপনার শক্তি?
মাশরাফি : কখনো হাল ছেড়ে না দিয়ে চেষ্টা করে যাওয়া এবং শেষ দেখে ছাড়া। অন্তত নিজের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেন বলতে না হয়, ‘আমি চেষ্টা করিনি।’
প্রশ্ন: আপনার দুর্বলতা?
মাশরাফি: এটি না হয় না-ই বললাম।
প্রশ্ন: আপনার ক্যারিয়ার লক্ষ্য?
মাশরাফি: ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে নতুন করে কী বলার আছে? আর যত দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আছি, নিজের সেরাটা যেন দিয়ে যেতে পারি।
কষ্টের শহর, যন্ত্রণার হাঁটু ও শেষ বিশ্বকাপ: এ পৃথিবীতে একটি বেদনার শহরও আছে তাঁর। যে শহরে বারবার গেছেন; কিন্তু কখনোই আনন্দের স্মৃতি নিয়ে ফেরা হয়নি। যা যা নিয়ে ফিরেছেন, সেসব শুধুই মাশরাফি বিন মর্তুজার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে গেছে। সেখানে বেশির ভাগ সময়ই গেছেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে, নয়তো ক্রাচে ভর দিয়ে। ফেরার সময়ও কতবার ক্রাচ ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী! একেবারে সুস্থ-সবল অবস্থায় যে কয়বার গেছেন, তাও নিষ্ঠুর শহরের পাষাণ হৃদয় গলেনি। প্রথম অধিনায়ক হিসেবে টানা দুই বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে যাওয়া মাশরাফির না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস ভারী করে আসা সেই শহরের নাম মেলবোর্ন।
তাঁর চোটগ্রস্ত দুই হাঁটু যেখানে বারবারই গেছে ডাক্তার ডেভিড ইয়াংয়ের ছুরি-কাঁচির নিচে। একই শহরে ২০১৫ বিশ্বকাপের ম্যাচ খেলতে গিয়ে ভাবছিলেন কেড়ে নেওয়ার শহর এবার যদি কিছু ফিরিয়ে দেয়! যদি কানায় কানায় ভরিয়ে দেয় প্রাপ্তির পেয়ালাও! কিন্তু তা আর হয়েছে কই? হয়নি বলেই অনিন্দ্যসুন্দর মেলবোর্নও তাঁর কাছে রুক্ষ মরুভ‚মি হয়েই থেকেছে, ‘গত বিশ্বেকাপে মেলবোর্নে দুটি ম্যাচ খেললাম। একটি কোয়ার্টার ফাইনাল, আরেকটি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে গ্রুপ ম্যাচ। যে ম্যাচ জিতলে হয়তো আমরা আরো আগেই চলে যেতাম কোয়ার্টার ফাইনালে। চিন্তা করলাম, এই মেলবোর্নে এসে জীবনে কত কষ্ট পেয়েছি। এখানে কত অস্ত্রোপচার হয়েছে, কত কষ্টের ভেতর দিয়ে গেছি! ভেবেছিলাম এ মেলবোর্ন নিশ্চয়ই এবার একটি আনন্দের মুহ‚র্ত দেবে। কিন্তু দেয়নি তো।’
আনন্দের মুহ‚র্ত না দিলেও ক্রিকেট ক্যারিয়ার-পরবর্তী জীবন নিয়ে আগাম টেনশন উপহার দিয়েছে ঠিকই, ‘‘মেলবোর্নে গিয়ে ভাবলাম ডেভিড ইয়াংয়ের সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। একদিন গেলামও। গিয়ে শুনে এলাম, ‘৪৫-৫০ বছর বয়সে তোমাকে কিন্তু হুইলচেয়ারে বসতেই হবে।’ অবশ্য সেই পরিণতি যাতে না হয়, সে জন্য বিকল্প ব্যবস্থার কথাও বলেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন ক্যারিয়ার শেষে যেন ‘নি রিপ্লেসমেন্ট’ (নকল হাঁটু বসিয়ে নেওয়া) করিয়ে নিই।’’ একই ডাক্তারের কাছ থেকে বছরখানেক আগে যা করিয়ে নিয়েছেন ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় সনাৎ জয়াসুরিয়াও। যাঁর হাঁটায় অক্ষমতার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছিল বেশ।
‘মাতারা হারিকেন’-এর সঙ্গে নিজের অবস্থা তুলনায় ক্যারিয়ার শেষে আরেকটি অস্ত্রোপচারকে অবশ্যম্ভাবীই মনে হচ্ছে মাশরাফির, ‘‘জয়াসুরিয়ার কিন্তু হাঁটুর চোট ওরকম ছিল না। এরপরও কিন্তু উনার একটি হাঁটুতে ‘নি রিপ্লেসমেন্ট’ করতে হয়েছে। আমার তো দুই হাঁটু মিলিয়েই অস্ত্রোপচার হয়েছে সাতবার। যাঁদের অস্ত্রোপচার অনেকগুলো হয়, তাঁদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নকল হাঁটু বসানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। আমার ক্ষেত্রে যে অবস্থা, তাতে ক্যারিয়ার শেষে এটি মোটামুটি অবধারিত বিষয়ই হয়ে আছে।’’ নিজেই যখন বলে দিয়েছেন যে ইংল্যান্ডেই শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন এবং এরপর ক্যারিয়ারও আর খুব বেশি দীর্ঘায়িত করবেন না বলে সাধারণ ধারণা, তখন নকল হাঁটু বসানোর সময়ও ঘনিয়ে আসছে বলা যায়। এর আগে বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়কের ভাগ্যে কী লিখে রেখেছে তাঁর শেষ বিশ্বকাপ? অভ‚তপ‚র্ব কোনো সাফল্যের আশা আছে মাশরাফিরও। কিন্তু ভাগ্যে পরম বিশ্বাসী এই পেসার আবার শত চেষ্টায়ও ভাগ্য বদলানো যায় বলে মনে করেন না, ‘আপনি যদি কিছু পান, সেটি আপনার ভাগ্যবদল নয়। আমি মনে করি, সেটি নির্ধারিতই আছে।’
২০১৪-র শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঘোর দুঃসময়ে আবার নেতৃত্ব ফিরে পাওয়া অধিনায়কের একের পর এক সাফল্যও তাহলে নির্ধারিতই ছিল। দর্শনের এই ছাত্রের কথা মানলে নির্ধারিত হয়ে আছে তাঁর শেষ বিশ্বকাপের ভাগ্যও। বেদনার শহরে বিলীন এই ক্রিকেটারকে প্রাপ্তির দুই ক‚ল উপচানো ঢেউ ভাসিয়ে নিচ্ছে কি না, সেটি জানতে তাই আপাতত অপেক্ষাই শেষ কথা!
ইনিউজ ৭১/টি.টি. রাকিব
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।