প্রকাশ: ৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০:৩২
মেহেরপুরে ইটভাটা নিয়ে জেলা প্রশাসনের দ্বৈতনীতিতে ক্ষোভ বিরাজ করছে ভাটা মালিকদের মধ্যে। জেলা প্রশাসনের মত অনুযায়ী, মেহেরপুর জেলার প্রতিটি ইটভাটাই অবৈধ। কিন্তু কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগ এসব অবৈধ ইটভাটা থেকে শতভাগ ভ্যাট আদায় করছেন।
মেহেরপুর জেলায় ১০৪টি ইটভাটা রয়েছে। পরিবেশের অনুমোদিত ইটভাটা হাতেগোনা ১০টি বাদে একটিরও নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকার কারণে জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। শুধু একটি ট্রেড লাইসেন্সের ওপর ভিত্তি করে ভাটাগুলোতে ইট তৈরি করা হয়। ফলে ৯৯ ভাগ ইটভাটাই অবৈধ।
ভাটা মালিকদের দাবি, সরকারের নীতিমালা মেনে ভাটা স্থাপনে তারা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু কোনো অনুমোদন পাচ্ছেন না বছরের পর বছর।
চলতি বছর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার নামে প্রতি হাজার ইটের দাম বাড়ানো হয়েছে তিন হাজার টাকা। সরকারিভাবে বিভিন্ন দিবস পালনের ব্যয় মেটাতে এসব ভাটা মালিক তাদের সমিতির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বলে ভাটা মালিকদের দাবি।
অবৈধ্য হলেও ভাটাগুলো থেকে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে সাড়ে চার কোটি টাকার বেশি। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এসব ভাটা থেকে ৪ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এর আগের অর্থবছরগুলোতে ভ্যাট আদায় কোটি টাকার ঘরে আসেনি, বরং কোটি টাকার ওপরেই রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের অনুমোদন না থাকা প্রতিটি ভাটা মালিক পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ভাটাগুলোতে ইট তৈরি ও বিক্রি করছেন। আবার এসব ভাটায় জ্বালানি হিসাবে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। সিংহভাগ ভাটা মালিক ক্ষমতাসীন দলের পদবিধারী নেতা, কিংবা দলের আশীর্বাদপুষ্ট।
জেলা ও জেলার বাইরের বনাঞ্চলের গাছ ধ্বংস করে লাখ লাখ টন কাঠ পোড়ানো হচ্ছে মেহেরপুরের ভাটাগুলোতে। আবার এসব ইটভাটার ৯০ শতাংশ নির্মিত হয়েছে আবাদি জমি ও আবাসিক এলাকায়। এসব ইটভাটায় বছরে ব্যবহৃত হচ্ছে ২০ কোটি ঘনফুট মাটি। যার বেশিরভাগই কৃষি জমি থেকে সংগৃহীত এবং ফসলি জমির উপরাংশের মাটি। ফলে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষিত হচ্ছে অপরদিকে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে চলে যাচ্ছে। মাটি নেওয়া জমিগুলোতে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন টিনের চিমনি ভাটা থেকে বন্ধ করতে পারলেও ভাটাগুলোতে কাঠ পোড়ানো বন্ধ এবং আবাদি জমির ওপরের অংশের মাটি ব্যবহার বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারছে না। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, সামাজিক বন বিভাগ ও ইটভাটার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের জরিপের তথ্যমতে, প্রতি মৌসুমে (নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) একটি ভাটায় ২৫ লাখ ইট তৈরিতে ২ লাখ ৫০ হাজার ঘনফুট মাটি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কোনো ইটভাটাতেই সরকারি নিয়ম মেনে ইট প্রস্তুত করা হয় না। প্রতিটি ইট লম্বায় ১০ ইঞ্চি, প্রস্থে ৫ ইঞ্চি এবং পুরুত্ব হতে হবে আড়াই ইঞ্চি। কিন্তু কোনো ইভাটাতেই এ নিয়ম না মানায় সরকারি ভবন নির্মাণে ঠিকাদারদের যেমন অতিরিক্ত ইট ব্যবহার করতে হচ্ছে। আবার ইট ছোট হওয়ার কারণে প্রতি হাজার ইটে যে ঘনফুট খোয়া তৈরি হওয়ার কথা তারচেয়ে কম খোয়া প্রস্তুত হচ্ছে। ফলে ঠিকাদারদের লোকসান গুনতে হচ্ছে ইটের সঠিক মাপ না থাকার কারণে।
সরেজমিন জেলার বিভিন্ন ইটভাটা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ ইটভাটাতেই জ্বালানি হিসাবে কাঠ জোগাড় হয়েছে। কোনো কোনো ইটভাটাতে গত নভেম্বরেই ইট পোড়ানো শুরু হয়েছে। ভাটাগুলোতে লোক দেখানো টনখানেক করে পাথর কয়লার স্তূপ পড়ে আছে। রাতের বেলা ভাটার পাশে ভ্রাম্যমাণ করাতকল এনে কাঠ চেরাই করে নেওয়া হচ্ছে ভাটায় জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারের জন্য।
মেহেরপুর জেলা কাস্টমস ভ্যাট কর্মকর্তা এমাদুল হক জানান, জেলায় ১০৭টি ইটভাটার মধ্যে চলমান আছে ১০৪টি। চলতি বছরে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৪ কোটি ৬৮ লাখ। নতুন নিয়মে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি না থাকলে ভাটা স্থাপন করা যাবে না। এজন্য ভাটা মালিকেরা চেষ্টা করছেন শর্ত পূরণের।