প্রকাশ: ১ মে ২০২১, ১০:৫৮
একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা নব্বই বছর বয়সী নুরুল ইসলাম ভাঙা ঘরে বসবাস ও আটা-চিড়া খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর এবার তাকে আর্থিক সহায়তা ও নতুন ঘর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।
শুক্রবার সন্ধ্যায় গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের উত্তর মরুয়াদহ গ্রামের নুরুল ইসলামের বাড়িতে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন। একই সাথে ঘর নির্মাণের যাবতীয় অবকাঠামোর হিসাব-নিকাশও নিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার 'বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতার দিন কাটে আটা-চিড়া খেয়ে' শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম। এই খবর নজরে আসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের গাইবান্ধা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহবায়ক শেখ রোহিত হাসান রিন্টুর। যা তাকে ব্যতিত করে। এরপর তিনি নিজস্ব ব্যক্তি উদ্যােগে নুরুল ইসলামকে ঘর দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সন্ধ্যায় গাইবান্ধা থেকে তিনি স্ত্রী মোছা. রোকসানা হাসান ও শেখ আরোহীসহ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের জেলার সহ সভাপতি মাহমুদুল ইসলাম মানিককে সাথে নিয়ে নুরুল ইসলামের বাড়িতে যান। প্রথমে তিনি নুরুল ও তার পরিবারের খোঁজ খবর নেন। এরপর ভাঙা ঘরটির চারপাশ ঘুরে দেখেন।
এ সময় তিনি ফলমূলসহ নানা রকম ইফতার সামগ্রী নুরুলের হাতে তুলে দিয়ে নতুন ঘর করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। একই সংগে ভাঙা খাট পাল্টিটে দুইটি নতুন খাট দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন।এ বিষয়ে শেখ রোহিত হাসান রিন্টু বলেন, 'গণমাধ্যমে ভিডিওতে দেখলাম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়দাতার করুণ অবস্থা। আমিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তার। আমার শরীরে মুক্তিযোদ্ধার রক্ত বইছে। এটা দেখে খুবই খারাপ লেগেছে। চোখে পানিও চলে আসে আমার।'
'ঠিক তখনেই সিদ্ধান্ত নেই; আমি তার পাশে দাঁড়াবো। তাকে ঘর উপহার দেব। এই নতুন উপহারের ঘরেই তারা যেন ঈদ করতে পারে; সেই চেষ্টাই করবো।'আজকে আমি ঘরের যাবতীয় অবকাঠামোর হিসাব ও লোকটিকে এক নজর দেখতে ছুটে এসেছি। এখানে এসে তারাও খুব খুশি হয়েছে; যা আমার মনকে প্রফুল্ল করেছে।'
রিন্টুর সফরসঙ্গী মাহমুদুল ইসলাম মানিক বলেন, 'একজন মুক্তিযোদ্ধার আশ্রয়দাতা ও অসহায়ের পাশে দাড়ানোর জন্য এসেছি। এখানে এসে বৃদ্ধ চাচাকে ঘর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এই ঘরটি পুরোপুরি আমার ছোট ভাই রিন্টুর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে নির্মাণ করা হবে।'
এদিকে, হঠাৎ করেই বাড়ির সামনে মাইক্রোবাস ও লোক দেখে অবাক বৃদ্ধ নুরুল ইসলাম। পরে তিনি যখন জানতে পারলেন; তারা ঘর দিতে এসেছেন তাকে। এটা শুনে চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে নুরুল ইসলামের।
প্রতিক্রিয়ায় নুরুল ইসলাম বলেন, 'কেউ কিছু দিল না, আর এমরা ভিনদেশি মানুষ দয়া করে হামাক ঘর দিল। মেম্বর; কত যে মেম্বরের পাও ধরি বেড়াছি-তাও হামাক ঘর দেয় নাই। হামি তাজ্জব নাকছি; কেমন বাহে, এত হাটাহাটি করিও পানো না- আর কালকেই কথা আজেই হয়া গেল। হামি একেবারে অবাক হয়া গেন।'এ সময় তিনি কপালের দিকে হাত ইশারা করে বলেন, 'আজ তো কপাল ফাটি গেছি হামার। ঘর পানো।'
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'লক্ষীপুরে আবেদ আলী আর্মি মোর ঘরত আসি দুই তিন মাস আছিল। গাইবান্ধার মুক্তিযোদ্ধা কত হামার বাড়িত আসি থাকছে। তামাক ফির জমি বেচি খিলেছম। এক বিঘা জমি দিয়ে এক দন ধান আনছম, ওমারে জন্যে। তামাক হামি এ ঘরে, ও ঘরে জাগা দিলেম। জমি বেচি ভাত খিলেছম। আর হামার ভাগ্যে কিছু হয় না।'
পরে তিনি একাত্তরের দু:খ ভুলে ঘর পাওয়ার আনন্দে বলেন, 'আজ হামি মহা খুশি। খুব শান্তি পানো। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লার কাছে আরাধনা-নামায পড়ে তার জন্যে দোয়া করমো। এই চেংরা হামাক এতবড় জিনিস দান করি গেল। আল্লাহ তাক ভাল রাখুক।'
তিনি বলেন, 'এই একটা ভিনদেশি চেংরা হামার বাড়িত আইল। মেলা মেলা জিনিস আনছে, ইফতারি আনছে; টেকা দিল। খুব ভাল আনন্দ হচ্চে। আজকে ভাল করি ইফতারি করমো। আলহামদুলিল্লাহ।'এর আগে বৃহস্পতিবার নুরুল ইসলামের করুণ জীবনযাপনের সংবাদ দেখে একটি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক তার বাড়িতে বাজার সদাই পাঠায়।
এছাড়া পবিত্র ঈদুল ফিতরে নুরুল ইসলামের পরিবারের চার সদস্যদের জন্য জামা-কাপড়সহ অন্যান্য সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন ওই সম্পাদক।একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার টিনের ঘরটি ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এখন সেটি জীর্ণশীর্ণ। জং ধরা টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে।
আর এই ঘরের মালিক নুরুল ইসলাম বয়সের ভারে ন্যুব্জ। নব্বই ছুঁইছুঁই। একসময় ছিলেন ধনী। প্রায় ৩০ বিঘা জমি ছিল তার। সেই জমির অনেকটা অংশ দান করেন স্থানীয় উত্তর মরুয়াদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। বাদবাকি জমি বিক্রি করে দেন। এখন ৫ শতাংশ ভিটাবাড়ি ছাড়া সহায়সম্বল বলতে কিছু নেই।
অথচ তার আজও জোটেনি বয়স্ক ভাতার কার্ড। না পেয়েছেন সরকারি একটি ঘর, না কোনো সহায়তা। এখন তার দিন কাটে অর্ধাহারে, অনাহারে, আটা-চিড়া খেয়ে।নুরুল তার স্ত্রী মজিরন বেগম ও পাঁচ বছর বয়সী নাতি রোম্মান মিয়াকে নিয়ে থাকেন ওই ভাঙা ঘরে।
এই দম্পতির একমাত্র ছেলে ঢাকায় রিকশা-ভ্যান চালান। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান লকডাউনে তিনিও বাড়ি ফিরে এসেছেন।এদিকে প্রকাশিত সংবাদটি ইতিমধ্যে সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নবীনেওয়াজ নজরে পড়েছে। সংবাদটি দেখে তিনি দু:খ প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে ইউএনও বলেন, ‘ঈদুল ফিতরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যােগে যিনি নুরুলকে ঘর করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।'এছাড়া নুরুল ইসলামকে সরকারি বরাদ্দ পেলেই পাকা ঘর করে দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
#ইনিউজ৭১/জি/হা/২০২১