চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ালেও দারিদ্রতা কমেনি শ্রমিকদের

নিজস্ব প্রতিবেদক
এহসান বিন মুজাহির থানা প্রতিনিধি শ্রীমঙ্গল , মৌলভীবাজার
প্রকাশিত: বুধবার ১লা মে ২০২৪ ০৭:৪৭ অপরাহ্ন
চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ালেও দারিদ্রতা কমেনি শ্রমিকদের

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত চা বাগানে যারা কাজ করেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা। প্রতিবছর মে দিবস আসে আবার চলে যায়। কিন্তু তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার কোনো বদল আজও হয়নি। এখনো অনেক শ্রমিককে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে চা পাতা তুলে, সেই খরচ দিয়ে সন্তানদের পড়াশোনা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর পুরুষ শ্রমিকদের অধিকাংশই বেকার। আর যারা নিয়মিত কাজ করছেন তারা কোম্পানি থেকে যা পান সেটা দিয়ে সংসার চলে না। এ নিয়ে তাদের অভিযোগের শেষ নেই। মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি তাদের। 


কিন্তু বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন চা শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। চা বাগানের শ্রমিকরা ২০০ বছর ধরে তাদের শ্রম দিয়ে চা বাগান আগলে রাখলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা এখনো অবহেলিত। সরকার তাদের আবাসস্থল নিজ নিজ মালিকানায় করে দিবে বললেও এখনো সে উদ্যোগের কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ প্রতি বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেও চা শ্রমিকদের ছেড়ে যায়নি দারিদ্র্যতা।


চা শিল্প ও বস্তি এলাকার বেকার নারী শ্রমিকরা বৈষম্যমূলক মজুরিতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। 


মে দিবসকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিনোদন আর ৮ ঘণ্টা বিশ্রামের অধিকার থাকলেও জীবন আর জীবিকার তাগিদে শ্রীমঙ্গল উপজেলার নারী-পুরুষ ও বেকার শ্রমিকরা মে দিবসে অর্জিত অধিকার থেকে বঞ্চিত। যাদের শ্রমে অর্জিত হচ্ছে হাজার কোটি বৈদেশিক মুদ্রা, তাদের অবহেলিত না রেখে অধিকার বাস্তবায়ন করা হোক এমনটাই প্রত্যাশা চা শ্রমিক নেতাদের। 


শ্রীমঙ্গল ভাড়াউড়া চা বাগানের মনি গোয়ালা, লছমী রাজভর, আলীনগর চা বাগানের রেবতি রিকিয়াশনসহ নারী শ্রমিকরাও জানান, তারা ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা সেরে কাজে বের হন আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রান্নাবান্না করেন। এটি চা বাগানের বেকার নারীদের প্রতিদিনের চিত্র। এভাবেই চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম। বস্তির অতি দরিদ্র ও চা শিল্পে শ্রমজীবীদের একটি বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে বেকার। চা বাগানের নারীদের কাছ থেকে সস্তায় শ্রম পাওয়া যায়।


নারী শ্রমিক পারভীন বেগম ও শেফালি কর বলেন, পেটের দায়ে যখন যে কাজ পাই সেটা করতে আমরা বাধ্য হই। তারপরও দেড়শ কিংবা দুইশ টাকা রোজ দেওয়া হয়। এটি দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। আর পুরুষরা কাজ করলেই তিন থেকে চারশ টাকা পান। আমরাও পুরুষদের চেয়ে কাজ কম করি না। তবে পারিশ্রমিক কম পাই।

তারা জানান, প্রতি বছর চা বাগানের অনেক মানুষ নিয়ে আমরা মে দিবস পালন করি। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা সবার কাছে তুলে ধরি। কিন্তু আমাদের এই আন্দোলন কে শুনবে, কী হবে আর মে দিবস পালন করে।


আলাপকালে শ্রমিকরা আরও বলেন বর্তমান শ্রমিকবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি, এই অবহেলিত চা শ্রমিকদের বাসস্থানের জায়গাটুকু যাতে তাদের নিজের নামে করে দেওয়া হয়। যাতে বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের যখন তখন ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারে।


শ্রীমঙ্গলে বালিশিরা ভ্যালীর সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি হলো চাকরির কোটা, শিক্ষা কোটা, বাসস্থান, ভূমি এই মৌলিক অধিকার যেগুলো রয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে যাতে এগুলো পূরণ করা হয়। এই দেশে আমরা মানুষ হিসেবে আছি চা বাগানের চা শ্রমিকরা পিছিয়ে পড়া জাতি এবং অনেক পেছনে রয়েছি এই দেশের সঙ্গে তাল মিলাতে হলে আমাদের কাছে সরকারকে আসতে হবে, চা শ্রমিকদের কথা বলতে হবে চা বাগানের মালিকদের।



শ্রীমঙ্গলে ফিনলে টি ভাড়াউড়া ডিভিশন জেনারেল ম্যানাজার গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, অকশনে চায়ের দাম বৃদ্ধি না পাওয়াতে ক্ষতিগ্রস্থ বাগান মালিকরা। অনেক মালিক শ্রমিকদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমনটা বজায় থাকলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে চা বাগান।


মৌলভীবাজার শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম বলেন, তবুও তাদের দাবি-দাওয়াসহ নানা বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে শ্রীমঙ্গলে স্থাপিত বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তর। চা শ্রমিকদের আবাসনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সক্রিয় বিবেচনায় আছে। তা ছাড়া ইতোমধ্যে ২৬৫ জন চা শ্রমিকের প্রত্যেককে সরকারিভাবে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ঘর দেওয়া হয়েছে। ৩৫ হাজার শ্রমিককে প্রতি বছর ৫ হাজার টাকা করে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি তারা গুরুত্ব সহকারে দেখছেন।


২০২৩ সালে বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হয়। গত বছর দেশের ১৬৮টি বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা–চাষিদের হাত ধরে উৎপাদিত চায়ের পরিমাণ ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে প্রথম পরীক্ষামূলক চা চাষ শুরুর পর ১৮৪ বছরের ইতিহাসে গত বছর প্রথমবারের মতো চা উৎপাদন ১০ কোটি কেজি ছাড়ায়। এর আগে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছিল ২০২১ সালে। সে বছর দেশের সব বাগান মিলিয়ে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চায়ের উৎপাদন হল, এখন সেটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ডে দাঁড়ায়। তৃতীয় সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয় ২০১৯ সালে। ওই বছর চা উৎপাদিত হয়েছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি