সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে মুখর হয়ে উঠেছে পুরো দেশ। ২০১৮ সালে সব ধরনের কোটা বাতিল করে জারি করা সরকারের পরিপত্র হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করার পর থেকে দেড় সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে শেষ কয়েকদিন রাজধানীসহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেন তারা। এবার এ আন্দোলনে নতুন রঙ চড়েছে চীন থেকে দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার করা এক মন্তব্যে। প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের অবমাননা করেছেন বলে দাবি কোটাবিরোধীদের। আর এ নিয়েই বিক্ষোভ মুখর এক রাত পার করেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতাকারী শিক্ষার্থীদের মিছিল-স্লোগানে উত্তাল ছিল ক্যাম্পাসগুলো, যাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করে ছাত্রলীগের পাল্টা মিছিল-স্লোগান।
বিক্ষোভে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বলেছেন, অন্যায্য কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলায় তাদের অপমান ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অপমান করার অধিকার কারও নেই। তারা এই অবমাননার প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছেন।
রোববার (১৪ জুলাই) রাত পৌনে ১১ টার পর সবচেয়ে বড় বিক্ষোভটি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গিয়ে সমবেত হন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ‘তুমি কে আমি কে- রাজাকার রাজাকার’, ‘এই বাংলার মাটি- রাজাকারের ঘাঁটি’- এরকম বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। মিছিল বের করতে গিয়ে কয়েকটি হলে ছাত্রলীগের নেতা এবং পদপ্রত্যাশীদের বাঁধার মুখে পড়েন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের তোড়ে পিছু হটতে বাধ্য হন তারা।
অবশ্য রাত ১টার দিকে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা হলে ফিরে গেলে বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে বের হয় ছাত্রলীগ। এসময় তারা মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিনে এসে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। এসময় তারা- ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘আছিস যত রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
এদিকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ফেসবুকে পদত্যাগ ঘোষণা করেন ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের চার নেতা পদত্যাগ। তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ছাত্রলীগের গণ যোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক মাছুম শাহরিয়ার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগের মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা উপ সম্পাদক রাতুল আহমেদ শ্রাবণ এবং কবি জসীমউদ্দিন হল ছাত্রলীগের দুই নেতা রাসেল হোসেন ও রাফিউল ইসলাম রাফি। কিছু সময় পরই অবশ্য পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আরেকটি পোস্ট করেন রাতুল আহমেদ শ্রাবণ। আর তাতে তিনি লিখেন, ‘পরিবার স্যরি, আমাকে মাফ করে দিয়েন।’
এদিন রাতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারীরাও। বিভিন্ন হল ও কটেজ থেকে মিছিল করতে করতে বেরিয়ে হাজারো শিক্ষার্থী জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে। এ সময় ‘চাইলাম অধিকার, হইলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে, আমি কে-রাজাকার, রাজাকার’-এমন বিভিন্ন স্লোগান শোনা যায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে৷
আরেকটি বড় বিক্ষোভ সংঘটিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাত পৌনে ১২ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হল থেকে হঠাৎ বিক্ষোভ শুরু করেন কিছু শিক্ষার্থী। মুহূর্তেই শত শত শিক্ষার্থী বিভিন্ন হল থেকে মিছিলে যুক্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা চত্বরের সামনে জড়ো হতে থাকেন তারা। এরপর প্রদক্ষিণ করেন পুরো ক্যাম্পাস। পরে রাবির প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী সড়ক অবরোধ করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।বিক্ষোভরত অনেকের হাতে দেখা যায় জাতীয় পতাকা। ‘ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘তুমি কে আমি কে-রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো রাবি ক্যাম্পাস।
মাঝরাতে মিছিলে-স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার' স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের ক্যাম্পাসেও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয় জাবির কোটাবিরোধীরা। খবর পেয়ে ছাত্রলীগ দুই শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে হেনস্তা করেছে বলেও অভিযোগ ওঠে। পরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ধার করে।
রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি পরে শাখারিবাজার হয়ে তাতিবাজারে যায়। ছাত্রী হলে তালা দিয়ে মেয়েদের আন্দোলনে যেতে নিরুৎসাহিত করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে ছাত্রীরা গেটের তালা ভেঙে অংশগ্রহণ করেন বিক্ষোভ মিছিলে।
রাত সোয়া ১২টার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হল থেকে বের হয়ে আসেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিল রেখে তারাও বিভিন্ন স্লোগানে মুখর করে তোলেন ক্যাম্পাস। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলেন, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী কখনো সে দেশের ছাত্রজনতাকে রাজাকারের বাচ্চা বলতে পারেন না। তার এমন উক্তির প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা এতো রাতেও রাস্তায় নেমেছেন।
অন্যদিকে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেন্ড গেটে জড়ো হতে থাকেন এবং ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় রাজাকারের ঠাই নাই’, ‘একটা একটা রাজাকার ধর, ধরে ধরে জবাই কর’, ‘ধরি ধরি ধরি না, ধরলে মোরা ছাড়ি না’ স্লোগান দিতে থাকেন। এসময় তারা লুৎফর হলের ভেতরে ঢুকে স্লোগান দিলে হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া’, ‘ভুয়া’ বলতে থাকেন।
মধ্যরাতে আরেকটি বিক্ষোভ হয় কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসের জিয়া মোড়ে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরালের পাদদেশে এসে মিলিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল এবং পাশ্ববর্তী মেস থেকে শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।
এসময় শিক্ষার্থীরা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন আমাদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন তখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাকে ভারতের দালাল আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু তিনি সেদিকে কর্ণপাত না করে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আমরা আজ শান্তিপূর্ণ ভাবে স্মারকলিপি জমা দিয়েছি। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সরকার প্রধানের বক্তব্য আমাদের হতাশ করেছে। আমাদের দাবিগুলো আমলে নিয়ে পড়ার টেবিলে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।
এর আগে রাত ১১টার দিকে বিক্ষোভে নামেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, কাজী নজরুল ইসলাম হল,শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল এবং শেখ হাসিনা হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় স্লোগান দিতে দেখা যায়। পরে সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু ও নজরুল হল থেকে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে জড়ো হোন বিক্ষোভকারীরা।
এছাড়া রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত একই ইস্যুতে বিক্ষোভ করেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলকালে ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘কে বলেছে? সরকার। কী বলেছে? রাজাকার’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন শিক্ষার্থীরা।
প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলনে আছেন কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবি জানানো শিক্ষার্থীরা। ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু গত ৭ জুলাই থেকে তারা এক দফা দাবির কথা বলছেন। দাবিটি হচ্ছে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করা। সব গ্রেডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। রোববার দুপুরে বঙ্গভবন অভিমুখে গণপদযাত্রা করে আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে।
তবে বিকেলে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা আন্দোলন নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে? তা তো আমরা হতে দিতে পারি না।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে কোটা আন্দোলনকারীদের মনে।
আপনার মতামত লিখুন :
বি: দ্র: প্রিয় পাঠক সমালোচনা আপনার অধিকার । তবে ভাষাটাও মার্জিত হতে হবে। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।