জলবায়ু পরিবর্তন, বিপর্যস্ত আশাশুনির উপকূল

নিজস্ব প্রতিবেদক
সচ্চিদানন্দদেসদয়, আশাশুনি উপজেলা প্রতিনিধি, সাতক্ষিরা
প্রকাশিত: শুক্রবার ১৯শে এপ্রিল ২০২৪ ০৯:২৪ অপরাহ্ন
জলবায়ু পরিবর্তন,  বিপর্যস্ত আশাশুনির উপকূল

জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বতমার্নে আশাশুনি এলাকায় অতি মাত্রায় নদী ভাঙ্গন,তাপদাহ,বড় বড় নদী ভরাট হওয়ায় চরম উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছে জনগন। গত তিন দশকে সামুদ্রিক ঘুর্নিঝড় ও জলোচ্ছাসে আশাশুনির উপকূলীয় জনপদগুলো লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে একদিকে যেমন সমুদ্র পৃষ্টের তলদেশ উঁচু হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে নদ-নদীর নাব্যতা হারিয়ে গতিপথে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারনে সমুদ্রের পানি উপকূলীয় এলাকায় উপচে পড়ছে।


যে কারনে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় অঞ্চল আশাশুনি সহ এ সকল এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ সহায় সম্বল হারিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছে।উপকূলীয়  অঞ্চলে  ১৯৮৮-এর ২৯ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় কেড়ে নিয়েছিল এ জনপদের  জীবনযাত্র্রার মান। কেউ হারিয়েছিলেন কোলের শিশু, কেউ স্ত্রী, কেউ স্বামী। 


সেই ভয়াল দিনের পর এখানে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর থাবা বসিয়েছিল ভয়াল সিডর। ২০০৯-এর ২৫ মে আঘাত হেনেছিল আইলা। এরপর আরও কয়েকটি ছোট-বড় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পর ২০১৯-এর ৪ মে ফণী, একই সালের ১০ নভেম্বর বুলবুল আঘাত করে লন্ডভন্ড করে দেয় আশাশুনি সহ সাতক্ষীরা-খুলনা উপকূলকে। এর ক্ষত না শুকাতেই ২০২০ সালের ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্পান এবং ২০২১-এর ২৬ মে প্রবল শক্তিধর ইয়াসের জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নেয় উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রগুলো।


 জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে ঘন ঘন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এভাবেই আঘাত হানছে। ২০০৭ থেকে এ পর্যন্ত গত ১৫ বছরে ১৩টি ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের দাপটে উপকূলীয় মানুষকে বারবার বসত পরিবর্তন করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণ, সম্পদ সবই। মানুষের বসবাসের মাটি কমে যাচ্ছে। লবণপানি গিলে খাচ্ছে কৃষিজমি। 


হাজার হাজার পরিবার হচ্ছে উদ্বাস্তু। জনজীবন হয়ে পড়ছে বিপর্যস্ত।আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক মাহাবুবুল হক ডাবলু বলেন,  ‘পরিকল্পনা মাফিক বেড়িবাধ করা হলে উপকুলীয় এলাকার মানুষ ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। জানা গেছে,সরকারের পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলো অনেক সংস্থার মাধ্যমে বাঁধ সংস্কার, কাঁচা রাস্তা নির্মাণ, ঝড় সহনশীল ঘর তৈরী, পয়নিস্কাশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন, গভীর অগভীর নলকূপ স্থাপন, রেইন ওয়াটার হার্ভেষ্টিং প্রকল্প বাস্তবায়নের মতো গুরুত্বপূর্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা দেশের উপকূলীয় বেশ কয়েকটি জেলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। 


প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ ঝড় জলোচ্ছাস জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে কিছুটা রেহাই পাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকারিলায় হতদরিদ্র মানুষের অসহায় অবস্থা, লবণাক্ততায় পরিবেশ বিপর্যয়, নদী ভাঙ্গনে বাড়ি ও জমি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তাদের এলাকা ছেড়ে পরিবার, স্বজন নিয়ে হচ্ছে শহরমুখী। গ্রাম ছেড়ে জেলা শহর, আবার জেলা শহর থেকে অন্য জেলায় তারা নীরবে অভিবাসিত হচ্ছে।


 ছিন্নমূল, বস্তিবাসী হয়ে ওরা নতুন জীবিকার সন্ধান করছে। পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকার ধনী ও সচ্ছল পরিবারে প্রায় ৫০ ভাগ পরিবার গ্রাম ছেড়ে এখন জেলা শহরে নতুন করে আশ্রয় গড়ে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপর্যস্ত আশাশুনির উপকূল এলাকা এখন পরিবেশবিদদের জন্য গবেষণার বিষয়। নদীর তলদেশ ভরাট, অপরিকল্পিত চিংড়িচাষ, নদী, খাল, পুকুরসহ নিরাপদ মিষ্টি পানির আধারগুলো দখল করে প্রভাবশালীদের লবণপানির মাছ চাষ, সাধারণ মানুষদের জীবন বিপন্ন করেছে।


 এসব সরকারী জমি প্রভাবশালীদের কাছে লিজ দেয়া হয়েছে। নদী শাসন, বন ধ্বংস করাসহ নানা কারণে প্রকৃতি এখন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। প্রকৃতির আচরণ এখন ভিন্ন। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি নেই। শীতের সময়কাল কমেছে। সব মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় উপজেলা হিসেবে আশাশুনি এখন প্রকৃতিগতভাবে বিপন্ন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্যোগ আর বৈরী আবহাওয়া সব মিলিয়ে আশাশুনি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার।