বই ও পাঠকের ভবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: বৃহঃস্পতিবার ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১১:৪৮ অপরাহ্ন
বই ও পাঠকের ভবনা

এবারের ২১শে বই মেলা শুরুর আগেই মুঠো ফোনে কথা হচ্ছিল কবি ও লেখক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর সাথে। কাজের চাপে যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি লেখকের অফিসে। "ভালবাসা কে জেনেছে   তারে" বইটির পাণ্ডুলিপি ছাপা আকারে  যখন লেখকের হাতে চলে আসে তখনই যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু সময় কাউকেই সেই অবসর টুকু দেয়নি। গতকাল বলা নেই কওয়া নেই হাজির হলাম বই মেলায়। ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হলাম অনিন্দ্য প্রকাশ স্টলের সামনে
 লেখক যথারীতি অন্যান্য লেখকদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন । আমাকে দেখেই হাসি মুখে উঠে এসে বুকে জরিয়ে নিলেন। দীর্ঘদিন পর দু'জনার দেখা। শেষ কবে দেখা হয়েছিল ঠিক কেউই মনে করতে পারছিলাম না । কথা হয় এই অনবদ্য মিশুক একজন লেখকের সাথে। মননশীলতা ও লেখার জগতে তাকে তরুনই বলা চলে। এ পর্যন্ত এই বই সহ মোট চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। 

লেখক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ভোলা জেলার বোরহান উদ্দিন থানার ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী পরিবারের সন্তান । পুরো পরিবারটি জাতীয়  রাজনীতির সাথে জড়িত কিন্তু তিনি থেকেছেন রাজনীতির ধরাছোঁয়ার বাইরে । পিতামহ মজিবুল হক চৌধুরী ছিলেন ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত এমএলএ,  পিতা ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,  সংবিধান প্রণেতা, সাবেক সংসদ সদস্য রেজা-এ-করিম চৌধুরী চুন্নু মিঞা । স্বাধীনতার ঠিক কয়েক বছর পূর্বে ১৯৬৮ সালে লেখকের জন্ম।
বই মেলায় দেখা হওয়ার পর চাইছিলাম লেখকের একটি স্বাক্ষাৎকার প্রকাশ করবো কিন্তু তিনি এতই প্রচার বিমুখ মানুষ যে কোন ভাবেই সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেন না । আমার সামনেই ফিরিয়ে দিলেন বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধিদের। আমাকে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত "ভালবাসা কে জেনেছে তারে" বইটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন প্রিয় ভাই বইটা পড়ে একটু সমালোচনা করে দিও।
আমি পরে গেলাম বিষম চিন্তায়। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে হয় তো যৎসামান্য লেখালিখি কিংবা পড়াশোনা আছে কিন্তু তাই বলে কোন লেখকের বইয়ের সমালোচনা লেখার মতন ধৃষ্টতা আমার নেই। 
কথা দিয়েছিলাম কিছু লিখবো এবং অনুমতি নিয়ে ছিলাম যেন লেখা পড়ে মনে কস্ট না পান।
গতকাল থেকে খুব সময় নিয়ে বইটা পড়লাম। যদিও মাত্র চার ফর্মা ৬৪পৃষ্ঠার বই । এক নাগাড়ে পড়লে হয়তো কোন পাঠকের সর্বোচচ ১থেকে দের ঘন্টা সময় লাগবে। 
শুরুতেই  নজরে এলো বইটির অনিন্দ্য সুন্দর প্রচ্ছদ । অসাধারণ প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী  চারু পিন্টু । বইটি লেখক উৎসর্গ করেছেন দু'জন শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে "আব্দুল মান্নান এবং ননী গোপাল দাস" 
পড়া শুরু করতেই নজরে এলো বইটির লেখা শুরুর পৃষ্ঠার বাম পাশ্বের দু'টো লাইন :
"রক্তের কি কোন ধর্ম আছে, হিন্দু, খৃষ্টান,বৌদ্ধ কিংবা মুসলিম?
আর সেকি নিজেই নির্ধারিত হয় কখন কার শরীরে প্রবাহিত হবে?
এই চরন দুটো বুঝতে হলে বইটি শেষ করতে হবে। বইয়ের শেষ লাইনও এই দুটো ।
বইটি পড়ে মনে হয়েছে এটি একটি প্রেমের উপন্যাস । তবে আমি একটু ভিন্ন ভাবে বলবো স্বল্পদৈঘ্য প্রেমের উপন্যাস । বইয়ের কলেবর অনুযায়ী উপন্যাস বলতে আমরা যা বুঝি এই বইয়ের কলেবর সে তুলনায় ছোট। আবার  সংঙ্গা অনুযায়ী ছোট গল্পও নয়। 
প্রসংগত বইটিতে যে গল্প লেখক তুলে ধরেছেন তা একটি প্রেমের গল্প।তবে বিবাহোত্তর প্রেম।
বইয়ে স্বরনে রাখার মতন বেশ কিছু ফিলোসফিক্যাল নতুন শব্দ চয়ন করেছেন যা সত্যি অতুলনীয় এবং অভাবনীয়। যেমন: আশা পূরণ হোক বা না হোক মানুষের আশা পূরণের আশা থেকেই যায়"
লেখক একজন গ্রাম্য দিন মজুরের জীবন জীবিকা ও তাদের জীবনের আশা -ভালবাসা তুলে আনার চেষ্টা করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। 
ফজলু-গগন, জোহরা-বাসন্তী, বাবলা-গনেশের জীবন চিত্রে তিনি আবহমান কাল থেকে আমাদের দেশের সামাজিক জীবনে এক অসাধারণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন তুলে ধরেছেন যেটা আসলে বাস্তব। 
লেখক নারী জাতির প্রতি অসামান্য সম্মান দেখিয়ে একটি কথা লিখেছেন যা অন্তরে টোকা দেয় । " এ দেশের নারী জাতির মধ্যে যে কত মহৎ, অসাধারণ হৃদয় রয়েছে,  কয়জন তা জানে" 
ঘটনার প্রেক্ষিত বইটি পড়লেই জানা যাবে।
সন্তানের পিতা হবার যে আকাঙক্ষা একজন পুরুষের মধ্যে কতটা প্রবল থাকে এবং সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর যত্ন কি করে একজন স্বামী নেয় তা এই বইয়ে  এখন চিত্রায়ণ করেছেন পটু হাতে । 
বইটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বইটির চরিত্রের কুশীলবদের ভাষা হচ্ছে ভোলা জেলার আঞ্চলিক কথ্য ভাষা । বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার আলাদা আঞ্চলিক  কথ্য ভাষা রয়েছে যা আমাদের ঐতিহ্য । ভোলা জেলার সাধারন মানুষের আঞ্চলিক কথ্য ভাষা এই বইটিতে ব্যবহার করতে লেখকের বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে বলে আমার ধারনা। কেননা আঞ্চলিক কথ্য ভাষা লেখার ক্ষেত্রে বানান লেখা বেশ কঠিন । তবে পাঠকদের জন্য আরও কঠিন । কেননা ভোলা জেলার আঞ্চলিক ভাষা অন্য জেলার মানুষ বুঝবে না এটা স্বাভাবিক তাই উক্ত শব্দগুলোর পাদটিকা দেয়া থাকলে পাঠকের সুবিধা হতো বলে আমি মনে করছি।
লেখকের লেখার ধরন এবং শব্দ চয়নে মনে হয়েছে তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , সমরেশ মজুমদার,  শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়,  এবং এসটি ক্লোরিজ দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়েছেন। যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত ধারনা সঠিক নাও হতে পারে।
সবশেষে বলবো, ছোট কলেবরে এবং সাধ্যের মধ্যে বিক্রয় মূল্য রাখাতে লেখক সবার মন করতে পারবেন।
আসলে বইটি না পড়লে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন না ভালবাসা কে জেনেছে তারে।